বদ্ধ নৌকার সুখ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

—আকাশের ওই যে লাল প্লেনটা গেল, তাতে করেই আজ সে দেশে আসবে।

—আরে ধুর! ওই লাল প্লেনটা রোদে লাল লাগছে। ওটা আসলে সাদা! তুই জানিস নাকি?

আকাশের মাঝে চলাচল করা বিচিত্র রঙের আর ধরনের প্লেনগুলো দেখে আমরা বন্ধুরা মিলে এভাবেই সেগুলো বিচার–বিশ্লেষণ করতাম। সময়টা হয়তো টিফিন পিরিয়ড বা কখনো স্কুল শুরুর আগে অথবা স্কুল শেষে বাসায় আসার পথেই।

সে যা–ই হোক, এই গল্পগুলো বেশ জমত। আহা রে! কিছুদিন আগেও এ বাক্যটা হয়তো এমন হতো—‘এই আড্ডাটা বেশ জমে!’ আর আজ? আজ ‘জমে’ শব্দটা তার ক্রিয়ার কাল পরিবর্তন করে ‘জমত’তে রূপ নিল। স্কুলে কাটানো ভীষণ রঙিন সে দিনগুলো, শত শত শিক্ষার্থীর মধ্যে ছুটির সময় হারিয়ে যাওয়া আর টিফিনে মাঠটাকে ধুলোময় করে তোলার যে কী আনন্দ, তা আমাদের দেশের অনেক শিশুই পায় না। কারণ, তারা ‘শিক্ষা’ নামক মৌলিক অধিকারটুকু থেকে বঞ্চিত।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্কুল বন্ধ থাকায় বাসায় থাকতে থাকতে আমি অনুধাবন করতে পারি সেই শিশুটার কথা, যাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই দেখতে পেতাম আইসক্রিমের প্যাকেটগুলো কুড়াচ্ছে। সেই শিশুটাকে কখনোই আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিনি, হয়তো তাকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করলেই আমি তার মধ্যে আমার আমাকেই খুঁজে পেতাম। হয়তো তার প্রতি এতটুকু সহানুভূতি আমার জাগ্রত হতো। কিন্তু বোধ হয় বড্ড দেরি করে ফেলেছি। হয়তো সে ছেলেটা করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক পরছে না, কিংবা সে হয়তো সময়মতো সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছে না। যখন আমি খেতে বসি তখন বারবারই তার কথা মনে পড়ে, কারণ হয়তো সে আজ ক্ষুধায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে, এখন যে আর সে আইসক্রিমের প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করতে পারছে না। আচ্ছা, কত টাকায় বিক্রি করত সে আইসক্রিমের প্যাকেটগুলো? কার কাছে করত? হয়তো খুব কম টাকা পেত, কিন্তু তা-ও তো পেত। এখন? কে জানে!

এখন অনিশ্চিত, আর কোনোদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তাকে দেখতে পাব কি না, আমার এই মুহূর্তের অনুভূতিগুলোকে ভিত্তি করে তাকে আলোর পথ দেখাতে পারব কি না। অনিশ্চিত এই ভবিষ্যতে তবু আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি একটি সুস্থ পৃথিবীর, যার মধ্যে আবার অজস্র শিশু খেলবে, শিখবে আর জানবে। আবার হয়তো কোনো শিশু তার সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যাবে, কেউ হয়তো বেরোবে বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলবেলা আনন্দে মেতে উঠতে, কিংবা কেউ হয়তোবা বেরোবে পত্রিকা ফেরি করে তার অসুস্থ মা–বাবার মুখে একটু ভাতের স্বাদ তুলে দিতে।

শিশুদের পাশাপাশি আরও একটি শ্রেণির মানুষের কথা এই বদ্ধ ঘরে আমার খুব মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন বৃদ্ধাশ্রমে অপেক্ষমাণ সেই কালজয়ী মানুষগুলোর কথা, যাঁরা হয়তো সারাটা বছর একটু বাইরে বেরিয়ে মুক্ত হাওয়ায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ভেসে যেতে চান প্রকৃতির মুক্ত-মুখরতায়। কিন্তু নিয়তি তাঁদের বেঁধে রাখে চার দেয়ালের মধ্যে, ঠিক আমারই মতো। আমি হয়তো একদিন সুস্থ পৃথিবীতে আবারও বুক ভরে শ্বাস নিতে পারব, এমনটা ভাবতে পারছি। তাঁরা তো এই ভাবনাটা ভেবে সান্ত্বনাটুকুও নিতে পারেন না।

আমার লেখাটা আর বাড়াব না। যে বা যাঁরা আমার লেখাটা পড়ছ বা পড়ছেন, তাঁদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, এই সময়ে আপনিও ভেবে দেখুন না আপনার আশপাশে থাকা এমন কোনো মানুষ বা কোনো শিশু কি ছিল যে এভাবেই দিন কাটাত? তার আজকের দিনের অবস্থাটা আমাদের একটু ভেবে দেখা উচিত নয় কি? আমরা যারা অনলাইনে বা কাগজে এই লেখাটি পড়ছি, তারা প্রায় সবাই-ই হয়তো এখনো দুবেলা দুমুঠো খেতে পারছি। আসুন না, সেই মানুষগুলোর কথা ভেবে তাঁদের পাশে দাঁড়াই, যাঁরা পাড়ে বেঁধে রাখা নৌকার মতো বদ্ধ হয়ে চেয়ে আছেন কোনো মাঝির আশায়, যার নিচের পানিটুকু শুকিয়ে গিয়েছে বহু আগেই।

* শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা। [email protected]