তত দিন বাঁচতে পারব তো আমরা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

‘রাত থম থম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায় নাই কোথা সাড়া কার।’ (পল্লিজননী—জসীমউদ্‌দীন)

শীতের তীব্রতায় আমলকী বন যেমন পাতা হারানোর ভয়ে থরথর করে কাঁপে, করোনাভাইরাসের ধ্বংসলীলা পৃথিবীকে সেভাবেই যেন কাঁপাচ্ছে। সেই কাঁপুনির ঝোড়ো দমকা হাওয়ার ঝটকায় হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ, বিলীন হচ্ছে মানবসম্পদ, ফুরিয়ে যাচ্ছে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই ভয়াল পরিস্থিতি চলতে থাকলে ধীরে ধীরে পৃথিবী হয়তো একসময় মানবশূন্য হয়ে যাবে। জসীমউদ্‌দীনের পল্লিজননী কবিতায় রূপকথার সেই নিঝুম অন্ধকারের মতো করোনার এই ভয়াল অন্ধকারে কারও সাড়া পাওয়াটাই যেন দায়। প্রফুল্ল নিশ্বাস ফেলানোর সেই তেজস্বীয়তাও আর নেই। ফেললেই আছে মহাবিপদ। ভ্রমরের ফুলে ফুলে ঘুরে মধু আহরণের মতো করোনার জীবাণু আহরণ করে যাবে নিত্যনতুন পোশাকে। আক্রান্ত করবে অচেতনভাবে, সহজে বোঝার সাধ্যটিও আর নেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পতিত ঝরনার স্রোত কালের বিবর্তনে যেমন গতিপথ পরিবর্তন করে রুদ্ধ হয়ে যায়, তেমনি ঘরবন্দী করে আমাদের রুদ্ধ জীবনের গতিপথ রেখার পরিবর্তন আনতে কণ্টকময় সিংহাসন ও সৈন্য নিয়ে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে চায় উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস। যার নিত্যনতুন রূপে ও লক্ষণে পুরো বিশ্ব আজ স্তম্ভিত, আতঙ্কিত এবং বিপর্যস্ত।

করোনাভাইরাসের এ খেলায় পৃথিবীর জীবন যেন নিভু নিভু প্রদীপের মতো বাতাসের সঙ্গে নিরন্তর লড়েই চলেছে। যেকোনো মুহূর্তে ফুরিয়ে যেতে পারে আয়ু। সেই নিভু নিভু প্রদীপের আলোর দীপ্তি বাড়িয়ে তোলায় বিজ্ঞানীদের শত চেষ্টারও কমতি নেই। চেষ্টা চলছে এবং চলবেই। পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। হারতেই হবে করোনাভাইরাসকে। তাই এখন শুধু একটাই কামনা—সুস্থ হয়ে ওঠো পৃথিবী। ফিরে আসো তোমার আপন রূপে, আপন মহিমায়। তবেই ফিরে পাব আমাদের স্বাভাবিক জীবন। ঘোচাতে পারব করোনার কালো অন্ধকার। বাঁচতে শিখব সুস্থ সবল নতুনভাবে। তবেই ছোট জানালার দৃষ্টির বন্দী শিকল ভেদ করে বেরিয়ে পড়ব আবার, নিজের গন্তব্যের সন্ধানে। ফিরে পাব সেই সোনালি দিনগুলো।

যাহোক, একদিন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে। পৃথিবীর বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড আবার সোজা হবে। জরাজীর্ণ সব ঝেড়ে, দূরে ঠেলে পৃথিবী ফিরে পাবে তার সজীবতা। তবু ঘুরেফিরে অজানা সংশয়ে সেই একটাই প্রশ্নই ফিরে আসছে বারবার, আঘাত হানছে মস্তিষ্কের ছোট কোটরে বারবার তত দিন বাঁচতে পারব তো আমরা! ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, দেশ থেকে বিশ্ব—সবখানেই করোনার আঘাত পৃথিবীকে করেছে বিপর্যস্ত। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি—সবকিছুকে আবার ঢেলে সাজাতে বাধ্য করছে। করোনার সেই কালো হাত থেকে বাদ যায়নি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও। করোনাভাইরাস অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য খাতের পরে ক্ষতি শিক্ষাব্যবস্থাকেও করেছে। তিন মাসের অধিক সময় বাসায় বন্দী থাকতে থাকতে ক্লান্ত-শ্রান্ত শিক্ষার্থীরা। তবু একরাশ আশা বুকে বেঁধে নিয়ে আছি—আবার আগের মতো হয়ে উঠবে পৃথিবী। এ আশাতেই এখনো রয়েছে বেঁচে থাকার আকুতি। কারণ, আশাহীন জীবন অর্থহীন। আশা আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকে, স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে। ডুবন্ত মানুষও তার জীবনের শেষ সময়টুকু আশা করে, কেউ আসবে তাকে উদ্ধারে। ফিরিয়ে দিবে তার জীবন। আমরাও সেই আশা করছি—করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে, পৃথিবী হয়ে উঠবে আগের মতো সুন্দর।

পরিশেষে আবার স্মরণ করছি আমাদের সেই গরিব দুঃখী খেটে খাওয়া মানুষদের, কবির কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে যদিও তাদের মানবেতর জীবন ক্ষুদ্র কালির রং দিয়ে চিত্রায়িত করা কঠিন। তবু বলি—

‘বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।’

আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সরকার এবং বিত্তবানেরা তাদের কল্যাণে এগিয়ে আসুক। মানবতা জাগ্রত হোক, মনুষ্যত্বের জয় হোক।

* শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]