বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ ডা. নজীর আহম্মদ স্মরণে

চিকিৎসক নজীর আহম্মদ বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসক নজীর আহম্মদ বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাস ১৯২৫ সালের ৩ জুন দামুড়হুদা থানার কুড়ুলগাছি ইউনিয়নের চাকুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আজগর আলী বিশ্বাস, মা সারাতন নেছা। শিমুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ৪র্থ শ্রেণি পাশ করে ১৯৩৬ সালে কলকাতার জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। স্কুল জীবনে সর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে এল. এম. এফ পাশ করে গ্রামের চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে গ্রামে ফিরে চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও কর্মজীবনের অধিকারী ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাস ১৯৫৫ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হকের ঋণ সালিশি বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৮ সালে মদনা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর কুষ্টিয়ার জজকোর্টের জুরির হাকিম পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একটানা ২০ বছর কুড়ুলগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৬ দফা ও অসহযোগ আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সকল সংগ্রামী কর্মসূচিতে তার অংশগ্রহণ ছিল অগ্রগণ্য।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাস স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। মানবিক মূল্যবোধ ও দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে মাঝদিয়া যুব-অভ্যর্থনা ক্যাম্পের চিকিৎসক ও উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বানপুর সাব-সেক্টর ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ছিলেন ও তৎকালীন বাংলাদেশ রেডক্রসের সহসভাপতি ছিলেন।

স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন এবং বাকশালের চুয়াডাঙ্গা মহকুমা কমিটির সদস্য হন ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও অবিচল আস্থা। ১৯৫৮ -১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ বছর অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে তিনি দামুড়হুদা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালে চুয়াডাঙ্গার গভর্নর হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৭৫ সালে ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধুর নির্মম মৃত্যুর পরবর্তী সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার ক্রান্তিকালে ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাস জেলা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং নতুন করে দলকে সংগঠিত করেন। এ সময় নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দু মাত্র বিচ্যুত হননি এবং সামরিক শাসকদের কোনো প্রলোভনই তাকে তাঁর ন্যায়ের পথ থেকে টলাতে পারেনি। ১৯৭৫-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পাট চাষি সমিতির কার্যকরী সদস্য ও কুষ্টিয়া-যশোর জোনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮০ সালের ১৭ জুন থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত সমিতির পক্ষ থেকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুদানসহ আরও অনেক দেশে সফর করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র সমবায় সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি সব সময় দরিদ্র এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। এই সমাজসেবী নেতা বার্ধক্য জনিত কারণে ১৯৯৩ সালের ২৫ জুন পরলোকগমন করেন।

ব্যক্তিজীবনে একজন সৎ, নির্ভীক, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে চিকিৎসক নজীর আহম্মদ বিশ্বাসের ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। তিনি ছিলেন মানুষের নিকট আস্থা ও ভরসার প্রতীক। মানুষের কল্যাণে উনার আত্মত্যাগ চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষ চিরদিন গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

এই গুণী মানুষটি আজ আমাদের মধ্যে নেই। আজ আলহাজ ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাসের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা পরিবারের সকলেই উনার জন্য দোয়া প্রার্থী। মহান আল্লাহ তায়ালা উনাকে জান্নাত নসিব করুন।


*লেখক: ডা. নজীর আহম্মদ বিশ্বাসের পৌত্র