তিন অক্ষরের অপেক্ষা

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মায়ের হাতেই আমাদের সবার অক্ষরের হাতেখড়ি। তাই অক্ষর শব্দটি শুনলেই ছোটবেলার মায়ের কোলে বসে অক্ষর শেখার কথা মনে পড়ে যায়।

আর অপেক্ষা! সে তো নিজেই অক্ষর যুগলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তার মাহাত্ম্য।

অপেক্ষা কখনো সুখের, আবার কখনো বেদনার। কিন্তু জীবজগতের প্রতিটি জীবকে অপেক্ষা করতে হয় হোক সেটা সুখের কিংবা বেদনার। ছোট্ট পিপীলিকা (সূক্ষ্ম চিনি দানা পাওয়ার পর, উৎস থেকে গন্তব্যে ফেরার অপেক্ষা) থেকে শুরু করে বৃহৎ হাতি (ক্ষুধা নিবারণ করার নিমিত্তে খাবার পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা), সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়।

আর আমরা তো মানবজাতি, তাই আমাদের অপেক্ষা নিত্যদিনের সঙ্গী।

কারও অপেক্ষা ভালোবাসার মানুষের জন্য, কারও বা অপেক্ষা পরিবারের সদস্যদের সুস্থতার জন্য, কেউবা অপেক্ষা করছে করোনা সেরে ওঠার জন্য, আবার কেউবা অপেক্ষা করছে করোনা কাটিয়ে সুন্দর সকাল দেখার জন্য, আবার কারও বা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অপেক্ষায়, কবে আড্ডা দেবে বন্ধুদের সঙ্গে সেই সোনালি ক্যাম্পাসে; এর অপেক্ষায়।

কিন্তু আমার অপেক্ষাটা একটু দীর্ঘ মনে হচ্ছে এখন। কিন্তু জানি না দিন শেষে অপেক্ষা সুখের হবে, না দুঃখের? যা-ই হোক, অপেক্ষা আছে এটা জানি।

এপ্রিল, ২০১৭

মায়ের হাতে শেখা সেই অক্ষর দিয়ে আজ শব্দ দিয়ে বাক্য, বাক্য দিয়ে রচনা লিখতে পারি। কিন্তু সেই তিন অক্ষর তখনো শেখা বা শোনা হয়নি। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার পর এক শহুরে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে শুনলাম আমার জীবনের প্রথম তিন অক্ষর—এনডিসি (নটর ডেম কলেজ)।

জুন, ২০১৭

এই দুই মাসের অপেক্ষা ছিল সুখের। কারণ এই তিন অক্ষরে চান্স পেয়ে গেলাম।

জুলাই, ২০১৭

আমার জীবনের একটি স্মরণীয় মাস এবং সাল। কারণ, এই মাসেই প্রথম শুনি দ্বিতীয় তিন অক্ষরের কথা। ছোটবেলা থেকে আমার এবং মা-বাবার স্বপ্ন ছিল চার অক্ষরের (মেডিকেল)। কিন্তু এই মাসেই তিন অক্ষরের (এনডিসি) এক শিক্ষকের কাছে তিন অক্ষরের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনতে পাই। সে দিন থেকেই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু তিন অক্ষরের জন্য।

অক্টোবর, ২০১৯

এভাবে প্রায় দুই বছরের অপেক্ষা শেষে প্রাণের তিন অক্ষরে চান্স পেলাম। এবারের অপেক্ষাটাও সুখের ছিল। যে তিন অক্ষরের কথা বলছি, সেটা আর অন্য কিছু নয় তা হলো আমার প্রাণের বুয়েট।

ফেব্রুয়ারি, ২০২০

সব অপেক্ষা দূরে ঠেলে দিয়ে, আমার মতো সব নবীনের পদচারণে তিন অক্ষরের ক্যাম্পাস মুখরিত (নবীনদের মুখের সেই পুলকিত হাসি দেখে গাছের ফুলগুলো যেন প্রাণ খুলে হাসতেছে, নবীনদের চিরতরুণত্ব দেখে গাছের পাতাগুলো যেন চিরসবুজ হয়ে যাচ্ছে, আভাময়ী বিল্ডিংগুলো তাদের আভা দ্বারা নবীনদের অভিনন্দন জানাচ্ছে)।

এভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে। আর অনুভব করলাম অগাধ প্রশান্তি এবং একবুক ভরা অভিনন্দনের আগমনী প্রশ্বাস নিলাম। এরপর ক্লাসে গিয়ে নবীনদের সেই চিরচেনা হাসির সঙ্গে পরিচয় পর্বটা ভালোই হলো।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসে তাই অনেক বেশি এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল। স্যার এসে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ,তোমরা সবাই কেমন আছো?’ এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কোনো স্যারের মুখে শোনা প্রথম বাক্য।

মাকে এসেই ফোন করলাম, মা আজকে আমি এক পিএইচডি (ডক্টরেট) পাওয়া স্যারের ক্লাস করেছি। আমি যেমন খুশি, মাও তেমনি খুশি। কিন্তু তখন জানতাম না বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক পিএইচডি ধারী।

এভাবে আনন্দে কাটতে থাকল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। কিন্তু তখনো জানতাম না এই আনন্দে বাধা হয়ে আসবে অপেক্ষা নামের করোনাকাল।

কিন্তু অজানা অপেক্ষা জানা অপেক্ষায় রূপ নিল খুব তাড়াতাড়ি। সে ঠিকই চলে এল...

করোনা নামের অপেক্ষা।

করোনা নামের এই অপেক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে তিন সপ্তাহে এবং হল জীবনকে (সিট স্বল্পতার কারণে করোনা ছুটির এক দিন আগে সিট পাই) এক দিনে আটকে দিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিন সপ্তাহ ছিল অনেক বেশি মজার এবং তার থেকেও মজার ছিল আউলার (আহাসানুল্লাহ হল) এক দিনের গল্প।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম হলের সেই ক্ষুধার্ত কুকুর-বিড়ালদের খাবারের জন্য অপেক্ষা। কিন্তু সেই অপেক্ষা বেশিক্ষণ থাকত না, কারণ অনেক সহৃদয়বান সিনিয়র ভাইকে দেখতাম দোকান থেকে কেউ বিস্কুট কিনে, কেউ পরোটা, কেউ চিড়া-মুড়ি কিনে দিচ্ছে কুকুরকে-বিড়ালকে। আবার কেউ হলের আগের রাতের খাবার দিচ্ছে কুকুর বিড়ালকে।

সত্যি, প্রতিদিন এসব দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ধরনের ভালো লাগত এবং নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতাম, ‘কারও অপেক্ষা পূরণের জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই আছে।’

কিন্তু আজ ভাবতেছি, আমার তিন অক্ষরের অপেক্ষা পূরণের জন্য কেউ কি আছে? নিজেই আবার নিজেকে বলি, ‘ধূর; তিন অক্ষরের (করোনা) অপেক্ষা শেষ না হলে তিন অক্ষরের (বুয়েট) অপেক্ষা কখনো দূর হবে না।’ এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দিই প্রতিদিন।

যেন তিন অক্ষরের ক্যাম্পাসের বাস্তব স্মৃতিগুলো আজ তিন অক্ষরের (বুয়েট) অপেক্ষায় কল্পনার মতো হয়ে যাচ্ছে।

তিন অক্ষরের (করোনা) প্রহর কখনো কী শেষ হবে?

তিন অক্ষরের (বুয়েট) অপেক্ষা কখনো কী ফুরাবে?

নাকি তিন অক্ষরের (বুয়েট) বাস্তব স্মৃতিগুলো কাল্পনিক হয়ে যাবে?

নাকি তার আগেই তিন অক্ষরের করোনা আমার তিন অক্ষরের অপেক্ষা শেষ (মৃত্যু) করে দেবে?

যা-ই হোক, দিন শেষে একটু আশায় বুক বাঁধি, এই বুঝি অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, এই বুঝি তিন অক্ষরে (বুয়েট) যাব।

কিন্তু আশার গুড়েবালি...

অপেক্ষা যে আর শেষ হচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন অপেক্ষা দূর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আশা ছাড়েনি। নিশ্চয়ই তিন অক্ষরকে (করোনা) শেষ করে তিন অক্ষরের (বুয়েট) পদচারণা শুরু করব।

তিন অক্ষরের (বুয়েট) অপেক্ষায় রয়েছি...

কিন্তু...

২০১৭ সালের জুন মাসের মতো অপেক্ষাটি কি সুখের হবে?

নাকি আজকের এই জুন আমাকে দুঃখের অপেক্ষা উপহার দেবে?

উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

*শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।