দেশে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত, তবু 'লোডশেডিং'

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত তিন দিন সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ (পিডিবি) সরকারের অন্যান্য ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, দেশের কোথাও ‘লোডশেড’ নেই। কিন্তু তিন দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। গ্রাহক ‘লোডশেডিং’ বললেও বিতরণ কোম্পানির ভাষায় এটি ‘টেকনিক্যাল ফল্ট’ বা কারিগরি ত্রুটি।

>চাহিদা না থাকায় উৎপাদন হয় অর্ধেকের কম। এরপরও বিদ্যুতের আসা-যাওয়া। কারণ, ত্রুটিপূর্ণ বিতরণব্যবস্থা।

পিডিবির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, দেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি থাকায় অর্ধেক কেন্দ্র অলস বসে থাকে। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়। গত ছয় বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। এ তথ্য ২৬ জুন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে পাঠকের মন্তব্য অংশে অনেকে অনলাইনে মন্তব্য করেন, তাঁদের এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।

পিডিবির কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারের হাতে যথেষ্ট বিদ্যুৎ থাকার পরও প্রধানত দুটি কারণে গ্রাম ও জেলা শহরে বিদ্যুৎ চলে যায়। এক. গ্রামে যেভাবে বিদ্যুতের লাইন স্থাপন করা হয়েছে, তাতে এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। কারণ, গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম ও এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব অনেক বেশি। এতে লাইন স্থাপনে ব্যয় অনেক বেশি। এসব গ্রাহককে বিদ্যুৎ দেওয়া লাভজনক হয় না। সে কারণে ওই সব এলাকায় দিন-রাত মিলিয়ে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম থাকে। এতে গ্রামের লোক বিদ্যুৎ পায় কম।

দুই. গ্রামে বিদ্যুতের লাইন গাছের ভেতর দিয়ে। যেকোনো সময় গাছের ডাল ভেঙে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া চাহিদার চেয়ে ট্রান্সফরমার কম থাকায় বাড়তি লোড নিতে গিয়ে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ ঘটে। এসব কারণেও বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।

দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এলাকায় ২৭ হাজার কোটি টাকার ১২টি প্রকল্পের কাজ চলছে। ঢাকা দক্ষিণের বিতরণ সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচ দিয়ে নেওয়ার জন্য প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে
বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হবে বলে আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত সত্ত্বেও লোডশেডিং কেন জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ১১ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন মাত্র ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। এখন উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২১ হাজার। সর্বোচ্চ প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছে। আগে দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিল এখন প্রায় শতভাগ। মানুষ আগে বিদ্যুৎ পেতই না। কিন্তু গত কয়েক বছর মানুষ বিদ্যুতের উন্নত সেবা পাওয়ায় জীবন বদলে গেছে। সে কারণে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলেই অনেকে মেনে নিতে পারেন না।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিতরণব্যবস্থার উন্নতির জন্য বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছু সমস্যা হয়। এ ছাড়া সারা দেশে বিতরণ লাইনগুলো মাটির ওপর দিয়ে নেওয়া। কিছু একটা হলেই সমস্যা সৃষ্টি হয়। দেশে বিদ্যুতের কোনো লোডশেডিং নেই। এটি টেকনিক্যাল সমস্যা। আগামী দুই বছরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন ১৩৭টি। এর সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট যুক্ত করলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২০ হাজার ২৭৯ মেগাওয়াট। সরকারি-বেসরকারি ও ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ এককভাবে কিনে থাকে সরকারি সংস্থা পিডিবি। এরপর পিডিবির কাছে থেকে এই বিদ্যুৎ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সঞ্চালনের মাধ্যমে সারা দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। এই ছয়টি বিতরণ সংস্থা সারা দেশে বিদ্যুৎ বিতরণ করে।

দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ২০১৯ সালের ২৯ মে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। বর্তমানে ৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু ১১ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, যথেষ্ট বিদ্যুৎ থাকার পরও সারা দেশে বিশেষ করে আরইবির ৮০টি সমিতিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকে না। এর কারণ হিসেবে সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পিজিসিবিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, পিজিসিবির সক্ষমতা নেই। প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে পারে না।

পিজিসিবির সক্ষমতা জানতে চাইলে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যত বিদ্যুৎ চাওয়া হয়, আমরা তা দিতে সক্ষম। যদি এ মুহূর্তে ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের চাহিদা পড়ে, পিজিসিবি এটি দিতে প্রস্তুত। আমরা আমাদের সিস্টেম আরও উন্নত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রচলিত বাস্তবতার মধ্যেও আমাদের এমন সংকট নেই, যার কারণে লোডশেডিং হবে।’

অভিযোগের শীর্ষে আরইবি

দেশে ছয়টি বিতরণ সংস্থা মোট ৩ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুতের সেবা দিয়ে থাকে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে দেশে শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসবে। বাকি থাকবে দুর্গম চরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ১৫৯টি গ্রামের মাত্র ৩ লাখ মানুষ। এসব মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যাবে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি গ্রাহক রয়েছে আরইবির ৮০টি সমিতিতে ২ কোটি ৯০ লাখ। আর পল্লী বিদ্যুতের এই গ্রাহকদের বিদ্যুৎ না থাকার ব্যাপারে সব থেকে বেশি অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মইন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আগে দিনে-রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। এখন অল্প সময়ের জন্য গেলেই মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। কারণ, অভ্যস্ততা। মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এটিকে লোডশেডিং বলা যাবে না।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন করা হয় না। তাহলে কেন জনগণ লো ভোল্টেজের মানহীন বিদ্যুৎ নেবে, যা আবার দফায় দফায় চলে যাবে। এসব অসংগতি দূর করার জন্য বারবার বললেও বিতরণ সংস্থাগুলো বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার যেসব যুক্তি দেখায়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের মতোই বিদ্যুতের বিল দেয়, তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।