'টু লেট' সাহেবের বাড়ি

বেতন বন্ধ, বাড়িভাড়াও বকেয়া পড়ছে কয়েক মাসের। করোনার প্রভাবে রাজধানীতে বসবাস করা অনেকের এখন এমন অবস্থা। জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পিকআপে বাড়ির সব মাল নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে একটি পরিবার। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটে।  ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বেতন বন্ধ, বাড়িভাড়াও বকেয়া পড়ছে কয়েক মাসের। করোনার প্রভাবে রাজধানীতে বসবাস করা অনেকের এখন এমন অবস্থা। জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পিকআপে বাড়ির সব মাল নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে একটি পরিবার। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

দেশে যুদ্ধ লাগেনি, বোমা পড়েনি কোথাও, অথচ প্রতিদিন শহর ছেড়ে দলে দলে চলে যায় মানুষ। গভীর রাতে কিংবা সকালের আলো ফোটার আগে আগে পুরোনো আসবাব আর গোল করে মোড়ানো তোশক নিয়ে ট্রাকগুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায়। চলে যায় গ্রামের দিকে, আগের প্রজন্মের পুরোনো কোনো ঠিকানায়। যে ঠিকানা এত দিন ছিল তাদের জিরিয়ে নেওয়ার গন্তব্য, দুটো ঈদ কিংবা পূজা সেখানে কাটত পরম আনন্দে, আজ বাধ্য হয়ে সেখানে ফেরা। আদরণীয় হোক আর না হোক, পরিবারের ফেলে আসা সদস্যদের সঙ্গে সেখানেই থাকা।

অবুঝ কোনো কিশোর হয়তো বাবার হাত ঝাঁকিয়ে বলে, আমি বন্ধুদের সঙ্গে আগের স্কুলে যাব না আর? হয়তো কোথাও দুজনের আয়ে টায় টায় চলা সংসারে তিল তিল করে গড়া সস্তার আসবাব ফেলে বা ছেড়ে গুটিয়ে নিতে হয় দুজনকে। আসবাব ফেলেই রাতের আঁধারে গা ঢাকা দেয় কেউ। আসবাব বিক্রি করে বাড়িভাড়া শোধ করে কোনোরকমে সরে যায় কেউ। কেউ আবার ভাঙা ভাঙা পরিবহনের নির্ভরতায় শেষ সম্বল পিঠা কি পান-সিগারেটের ব্যবসার দু-চারটা ফেলতে না পারা জিনিস কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা দেয়। যেতে যেতে হয়তো বুক চিরে আক্ষেপ বেরিয়েও আসতে পারে, যে শহরটাকে সে এতগুলো বছর দিয়ে দিল, সে শহর তার নয়!

ঢাকাকে বিদায়

ঢাকাবিমুখী মানুষের স্রোত চলছে কিছুদিন ধরে। কাজ হারানো বা বেতন না পাওয়ার বাস্তবতায় মেট্রোপলিটন শহরে বসবাসের যোগ্যতা প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলছে সাধারণ আয়ের মানুষ। জীবিকার অনিশ্চয়তায় নিম্নবিত্ত পরিণত হয়েছে হতদরিদ্রে আর কিছু মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনায়াসে নাম লিখিয়ে নিচ্ছে নিম্নবিত্তে। আশির দশকের শেষের দিক থেকে পোশাক, অন্যান্য শিল্পসহ বড় শহরের অগুনতি মানুষের বিচিত্র চাহিদা মেটানোর জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকামুখী মানুষের যে ঢল চলে এসেছে, তারা স্থায়ী হয়েছে ঢাকা আর তার আশপাশের এলাকায়। তাদের মধ্যে কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস শ্রমিক বা দিনমজুর বা গৃহকর্মী কেউ, অনেকে ছাত্র এবং গৃহশিক্ষক। কাজ তথা আয়ের অভাবে তাঁদের মধ্যে কেউ ইতিমধ্যে গ্রামে চলে গেছেন, কেউ কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আবার কেউ আশাবাদী হয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়িতে বসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার জন্য অপেক্ষা করছেন। বর্তমান বিবেচনায় হলফ করে বলা যায় না যে আগের জীবন তাঁরা তত তাড়াতাড়ি ফিরে পাবেন। তাই ঢাকা থেকে ছোট শহর বা গ্রামমুখী স্রোত হয়তো দীর্ঘদিন চলতে থাকবে।

জীবনযাপনের খরচ বৃদ্ধি

কম–বেশি ৩০ বছর আগে এই শহরে কাজের সন্ধানে আসতে থাকা অসংখ্য মানুষের বাসাবাড়ির প্রয়োজনে ছোট বাড়িগুলো ভেঙে তৈরি শুরু হয়েছিল বহুতল, নদী-ডোবা ভরাট হয়ে পরিণত হয়েছিল সস্তার পাড়ায়। দেখতে দেখতে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারব্যাপী শহরটির বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই কোটি। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৯ সালে দুটো শোবার ঘর সমৃদ্ধ যে বাড়ির ভাড়া ছিল গড়ে ১০ হাজার ৮০০ টাকা, সেই একই বাড়ির গড় ভাড়া ২০১৬ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৭০০ টাকায়। এই হিসাবে উল্লেখ্য এক দশকের কম সময়ে ঢাকায় সাধারণ মানুষের বাসযোগ্য বাড়ির ভাড়া ৮২.৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। এই চিত্র থেকে আন্দাজ করা যায়, মোটামুটি এক রকম বৃদ্ধির হারে বাড়তে থাকলে ২০১৬ থেকে আজকের সময় অব্দি ওই বাড়ির ভাড়া বর্তমানে ২৭ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

>ঢাকাবিমুখী মানুষের স্রোত চলছে কিছুদিন ধরে
কাজ হারানোর বাস্তবতায় মেট্রোপলিটন শহরে বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে নিম্ন আয়ের মানুষ

ভুক্তভোগীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বছরের শেষ ভাগে বাড়িতে উঠলেও জানুয়ারির প্রথম থেকে নিয়মমাফিক অন্তত কিছু ভাড়া বাড়ানোর জন্য বাড়িওয়ালারা চাপ প্রয়োগ করেন। বিষয়টিতে আরও কিছু হিসাব যোগ করলে, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের একই রিপোর্টে জানা যায়, উল্লিখিত এক দশকের কম সময়ে আনুষঙ্গিক সেবার মূল্যের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ৯৩ শতাংশ, পানি ৫৬ শতাংশ, গণপরিবহন ৪৫ শতাংশ এবং ঢাকা শহরে সামগ্রিকভাবে জীবনধারণের খরচ বেড়েছে মোটের ওপরে ৭১ শতাংশ হারে। এসব খরচ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কারণে এ দেশে একাধিকবার ক্ষুদ্র পরিসরে আন্দোলন হয়েছে, মানববন্ধন হয়েছে, কিন্তু সবকিছু ওই পর্যন্তই। সরকার নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তব প্রয়োগ জনগণ দেখতে পাননি; বরং বেশি ভাড়ার বাড়িতে বিদ্যুৎ-পানি খাতে অতিরিক্ত খরচ করে কেবল জীবিকার তাগিদে নিষ্ঠুর শহরে টিকে থাকার সংগ্রাম করে গেছেন। বিনিময়ে মিলেছে ক্রমাগত নিম্নগতির সুযোগ–সুবিধাময় জীবন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, নিয়মকানুন তৈরি বা প্রয়োগের জন্য যথাযথ কোনো কর্তৃপক্ষ নেই; থাকলেও তাদের নজরদারি সাদাকালো অক্ষরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিংবা তাত্ত্বিকভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো সবকিছু যেন চাহিদা আর সরবরাহের সমন্বয়ে এক অবাধ নীতিতে চলছে, যেখানে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর কার্যকর নীতিমালা কিংবা সরকারি হস্তক্ষেপ অনুপস্থিত।

বাড়িভাড়া পরিশোধে অপারগতা

সাধারণত একটা জায়গায় পরিবার–পরিজন নিয়ে বসবাস করতে থাকলে হাজারো অসুবিধার মধ্যেও মানুষ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে যায়। তেমনি রাজধানীর কিছু বিশেষ সুবিধা-অসুবিধার সঙ্গে কষ্ট করে হলেও তারা খাপ খাইয়ে নেয়। অন্যদিকে ফেলে আসা গ্রাম বা ছোট শহরে ফিরে গিয়ে নতুন করে জীবনসংগ্রাম শুরু করা বা কারও ঘাড়ে বোঝা হয়ে ওঠার কথা তখন মানুষ কল্পনা করতে পারে না। অথচ পরিশেষে করোনাকালের সাধারণ ছুটি কিংবা লকডাউনের কারণে তাঁকে সেই অবাঞ্ছিত উপায়টির দিকেই এগিয়ে যেতে হয়। অন্তত তিন মাস বেতন না পাওয়া কিংবা অর্ধেক বেতন পাওয়ার পরে চাকরিজীবী যেমন বাড়িভাড়া শোধ করতে অপারগ, তেমনি মানুষের সমাগমের অভাবে পান-সিগারেটওয়ালা বা পিঠাওয়ালার মতো যাঁরা বলতে গেলে দিন আনে দিন খান, তাঁদের পক্ষেও ভাড়ার অংশ শোধ করা সম্ভব হয় না। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণশ্রমিক, বেতন না পাওয়া কিংবা ছাঁটাই হওয়া পোশাকশ্রমিক অথবা কাজের অভাবে ফুটপাতে সারি বেঁধে বসে থাকা দিনমজুর—আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে যাঁদের খাদ্যের অভাবে মরে যাওয়ার জোগাড়, তাঁদের পক্ষে উচ্চ হারে বাসাভাড়া শোধ করে ঢাকা শহরে বসে থাকা অবান্তর। প্রকৃতপ‌ক্ষে, ভাড়া বাড়িতে বসবাসকারী মানুষ নিজ নিজ আয়ের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ বাসা ভাড়ায় খরচ করে। যে মানুষের পাঁচ শ থেকে এক হাজার টাকা এদিক-ওদিক হলে পুরো মাসের জীবনধারণের কায়দায় পরিবর্তন আনতে হয়, তাঁর কাছে আয়ের অন্তত ৩০ শতাংশ জমিয়ে রাখার ভাবনা এবং আয়বিহীন অবস্থায় তা বাড়িভাড়ায় খরচ করে ঢাকায় বসে থাকার চিন্তাও অসম্ভব। সুতরাং ভাড়া বাড়ি ছেড়ে সপরিবার গ্রামে চলে যাওয়া কিংবা পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে থাকা অনেকের জন্য সুবিধাজনক।

প্রতিশ্রুতির আশা ও হতাশা

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পক্ষ থেকে অনেক আগেই জানানো হয়েছিল যে করোনার প্রাদুর্ভাবে অন্তত ১ কোটি ৩ লাখ মানুষ চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকিতে আছেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন মানববন্ধন করে তিন মাসের বাসাভাড়া মওকুফ এবং যাবতীয় বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছিল। হাউজিং ট্যাক্স এবং বিল মওকুফ করলে হয়তো বাড়ির মালিকেরা এ বিষয়ে পদ‌ক্ষেপ নিতে পারতেন। এপ্রিলে মেয়র (দক্ষিণ) বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে দু–একজন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞসহ অনেকে আশা করেছিলেন, যাঁদের বাড়িভাড়া খুবই কম, মূলত ৫০০০ টাকার নিচে, অর্থাৎ অত্যন্ত অল্প আয়ের মানুষের সুবিধায় বাড়িভাড়া পরিশোধের জন্য হয়তো সরকার কোনো প্রণোদনা ঘোষণা করলেও করতে পারে। তবে সে রকম কিছু ঘটেনি।

ভাড়াটে বনাম বাড়িওয়ালা

বাস্তবে ঘটনার আরেক প্রান্তে আছেন বাড়িওয়ালা—বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়াটের ভাষ্যে সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে যাঁর অবস্থান। বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া আদায়ের বা বাড়ানোর জন্য বিরূপ আচরণ করেছেন—এ রকম অভিযোগ বহু ভাড়াটের কাছে অহরহ পাওয়া যায়। মনোবল বা আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে কিংবা বাড়িভাড়া আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে ভাড়াটের পক্ষে পদ‌ক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারার ঘটনাও বিরল নয়। যাহোক, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালা সম্পর্কে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ভাড়াটের ওপর অন্যায্য দাবি করেছেন বলে জানা গেছে বটে, তবে কিছু ক্ষেত্রে কেউ কেউ বাসাভাড়া না নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কেউ ভাড়া অর্ধেক গ্রহণেও সম্মতি দিয়েছেন। ওদিকে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ ভাড়াটের অর্ধেক ভাড়াও পরিশোধের সামর্থ্য নেই।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকার ৮০ শতাংশ বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাড়িই যেহেতু তাঁদের ব্যবসা, তাই বিভিন্ন বিল এবং করের ঊর্ধ্বগতি সাপে‌ক্ষে তাঁরা বছরে গড়ে ৯ শতাংশ ভাড়া বাড়ান। ৭৫ শতাংশ বাড়িওয়ালা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকেন। বাড়িভাড়া ছাড়া সাধারণত তাঁদের অন্য কোনো আয়ের উৎস থাকে না। তাই ঋণের কিস্তি পরিশোধ কিংবা সংসার চালানোর তাগিদে ভাড়া হাতে পাওয়া তাঁর জন্য জরুরি। অনেক বাড়িওয়ালার দৈনন্দিন ব্যয় ছাড়াও সন্তানের শিক্ষার খরচ এবং বয়স্কদের চিকিৎসা খরচ প্রাপ্ত বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে বাড়িতে ভাড়াটে না থাকলেও তাঁকে করের টাকা সময়মতো দিতে হয়। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে ভাড়াটে চলে যাওয়ায় বাড়ির মালিক অর্থের অভাবে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের জন্য নিয়মিত জরুরি চিকিৎসা (যেমন কিডনি ডায়ালাইসিস বা কেমোথেরাপি) চালিয়ে যেতে পারছেন না। মোটের ওপর বাড়িওয়ালার অবস্থানে থেকে তিনি চট করে কারও কাছে হাত পাততেও পারছেন না। ঢাকা শহরে যাঁর পাঁচ-ছয়তলা বাড়ি থাকে, তাঁর হয়তো কারও কাছে হাত পাতা শোভা পায় না। কেউ তাঁর সমস্যার কথা বুঝতেও চান না।

জোর করে বাসস্থান পরিবর্তনে মানসিক চাপ

২০১৯ সালের শেষে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় জানা যায়, ওই বছর পৃথিবীজুড়ে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বিরূপ আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধের কারণে বাসস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে কেউ নতুন করে জীবন শুরু করে, কেউ হয় উদ্বাস্তু। আমাদের দেশেই জ্বলন্ত উদাহরণ রোহিঙ্গা শরণার্থী। আর আজ অভিনব দুর্যোগে বহু বাংলাদেশি দেশের ভেতরে বাসস্থান ও কার্য‌ক্ষেত্র পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে। যেকোনো কারণেই হোক, আবাসস্থল জবরদস্তি পরিবর্তনের কারণে মানুষের মানসিক অবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পরিচিত পরিবেশ ও চেনা সাহচর্য হারিয়ে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। উদয়াস্ত পরিশ্রম যত কঠিনই হোক না কেন, আয়ের উৎস হঠাৎ করে হারিয়ে গেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানুষ দি‌গ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তে পারে।

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যয় কমাতে অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ও বাড়ি বদল করছেন। বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ভাড়ার বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে রাখছেন বাড়িওয়ালারা। এই বাড়ির ২৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৭টিই খালি। গতকাল রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকায়।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
করোনাভাইরাসের কারণে ব্যয় কমাতে অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ও বাড়ি বদল করছেন। বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে ভাড়ার বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে রাখছেন বাড়িওয়ালারা। এই বাড়ির ২৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৭টিই খালি। গতকাল রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকায়। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

আমাদের মতো দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে অবশ্য করুণ মানসিক অবস্থার চেয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকার সংগ্রামকে তীব্রতর হিসেবে গণ্য করা হয়। নতুন পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে খাপ খাওয়ানোর সংগ্রাম তাই তখন বলতে গেলে উপেক্ষার যোগ্য, বরং আয়ের নতুন উৎস খুঁজে বের করাই অপেক্ষাকৃত বড় চ্যালেঞ্জ। সেই উৎস খুঁজে বের করা পর্যন্ত পাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতা কাউকে
সারা জীবনের জন্য হতাশ করে দিতে পারে। গ্রামে পূর্বপুরুষের বাড়ি না থাকলে অন্যের আশ্রয়ে থাকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও জুটতে পারে, যা তাঁকে হয়তো অনেক দিন পর্যন্ত তাড়া করবে। অন্যদিকে আবাসস্থল ও শ্রেণিকাঠামোর পরিবর্তন তাঁদের ওপরে, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। বিভ্রান্ত হয়ে তারা ভাবতে পারে, তাদের আগের জীবনটা সাময়িক ছিল, নাকি এখনকারটা! তাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার বাড়তে পারে এবং অসম্ভব হলেও আগের অবস্থানে ফেরার বিফল চেষ্টায় দীর্ঘস্থায়ী হতাশা আসতে পারে।

কৃষিকাজে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

তবে যা–ই হোক, বহু মানুষের গ্রামমুখী এ যাত্রা মূলত কৃষিক্ষেত্রে নতুন আয়ের উৎস খোঁজার দিকে ইঙ্গিত করে। ঠিক যেমনটা দেখা গেছে লকডাউনের শুরুর দিকে পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা কারখানা বন্ধ হওয়ায় ধানকাটার কাজে যোগদানের উদ্দেশে গ্রামে চলে গেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কৃষি খাত নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে, যেখানে বেকার মানুষগুলোর কর্মসংস্থান হতে পারে। আবার সার্বিকভাবে কৃষিক্ষেত্রে নতুন পরিবর্তনও আসতে পারে। কৃষিনির্ভর শিল্প, যেমন পোলট্রি বা ডেইরির কার্যক্রম বৃদ্ধি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে উৎসে কর বা এত দিনের করমুক্ত পোলট্রিশিল্পে আকস্মিক কর নির্ধারণ বিষয়টিকে কিছুটা কঠিন করে তুলতে পারে।

সরকার হয়তো কৃষির সম্ভাবনা বৃদ্ধির নতুন পরিকল্পনার মধ্যে নিয়োজিত হবার কথা ইতিমধ্যে ভেবেছে। যেমন এ মাসে কুষ্টিয়া ও পটুয়াখালী শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে যে কৃষিজমি চাষবিহীন রাখা যাবে না। চাষের যোগ্য কৃষিজমি ফেলে রাখাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে, ১৯৫০ সালের আইন অনুযায়ী মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং জমিটি সরকারের আওতায় নিয়ে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। যদিওবা তখনকার সমাজে কৃষিজমির মালিক সাধারণত জমির কাছেই অবস্থান করতেন, যাতে তিনি বরাবর জমিতে ফসলের চাষ নিশ্চিত করতে পারতেন। এখনকার পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন—জমির মালিক দূরের শহরে এমনকি দেশের বাইরেও অবস্থান করতে পারেন, পরিচালনার অভাবে জমি পতিত থাকতে পারে। তবু সরকারের এই পদ‌ক্ষেপ কৃষি‌ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী চাষযোগ্য ৮৬ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে আড়াই লাখ হেক্টর পতিত। ওদিকে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারের দখলে থাকা শতভাগ জমিতে এখনো চাষাবাদ নিশ্চিত করা হয়নি। তাই পতিত জমির মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তের বেলায় স্ববিরোধী অবস্থানে না থেকে তার আগে চাষযোগ্য যাবতীয় সরকারি জমি চাষের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিলে তা বর্তমান পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবে দেশের জন্য সুফল বয়ে আনত। আজকে গ্রামমুখী মানুষের স্রোত সামাল দিতে তাই ইটভাটা বা অকৃষি খাতে জমি ব্যবহার করা যেমন উচিত হবে না, একই সঙ্গে কৃষিজমির ওপরে প্রস্তাবিত দীর্ঘমেয়াদি ইপিজেড নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত করে কৃষির উন্নয়নকল্পে সরকারি পতিত জমি ব্যবহার করাই বোধ হয় সমীচীন।

বস্তুত করোনাকালীন এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও পৃথিবীতে বিশ্বায়নের চর্চা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা আছে। নিজ সীমার ভেতরে দেশগুলো একেকটি দ্বীপাঞ্চল হয়ে পড়লে মানুষের এত দিনের স্বাভাবিক জীবনপ্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যাহত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে ঠিক কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা সময় বলে দেবে। তাই একদিকে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান এবং অন্যদিকে দেশের ভেতরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন—দুটো বিষয়ই এখন বিশেষ মনোযোগের দাবিদার।

শেষ কথা

যদি কোনো দিন করোনাকাল কেটে গিয়ে আবারও আগের দিন ফেরত আসে, তবু আসবে কিছু পরিবর্তন নিয়ে; সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। শহরমুখী স্রোত আবার ফেরত এলেও তখন জীবনযাপনের ব্যয় হয়তো হয়ে উঠবে আগের চেয়েও আকাশচুম্বী। খালি হওয়া আর দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বাড়িগুলো নতুন রঙে সজ্জিত হয়ে হয়তো আগের চেয়েও বেশি ভাড়ায় ভাড়াটেকে আকর্ষণ করতে চেষ্টা করবে। নতুন মানুষের ঢল বুকে নিয়ে শহরটা দেখতে কেমন হবে, তা জানার জন্য ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে আজকের শহরের রাস্তায় বাড়িতে বাড়িতে ঝোলানো ‘টু লেট’ সাইনবোর্ডের আধিক্য দেখলে আশির দশকে শোনা একটি কৌতুকের কথা মনে পড়ে; শহরে দু-চার দিন বেড়িয়ে যাওয়া ভাগনে গ্রামে ফিরে গিয়ে মামাকে বলে, শহরে সবচেয়ে বেশি বাড়ির মালিকের নাম ‘টু লেট’ সাহেব।

 আফসানা বেগম : কথাসাহিত্যিক ও পিএইচডি গবেষক, নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়