করোনার মতো দুর্যোগে বাল্যবিবাহের চর্চা বাড়তে পারে: ইউএনএফপিএ

বাল্যবিবাহ। প্রতীকী ছবি
বাল্যবিবাহ। প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির সংকটে দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বাড়ছে বলে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) মনে করে, করোনার মতো যেকোনো দুর্যোগ এবং সংকটের সময় বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর চর্চা বাড়তে পারে। আর এটি রোধে বিনিয়োগ এবং গতিশীল পদক্ষেপে নিতে হবে। 

আজ মঙ্গলবার ইউএনএফপিএর (যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা) ২০২০–এর জনসংখ্যা সম্পর্কিত প্রতিবেদন (স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট) প্রকাশিত হয়। এক ভার্চ্যুয়াল সভায় এটি প্রকাশ করা হয়। সেখানেই এই আহ্বান আসে জাতিসংঘের এই সংস্থার কাছে থেকে।

আজ বৈশ্বিকভাবে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ এবং ছেলে সন্তান পছন্দ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়।

এবারের প্রতিবেদনে প্রাধান্য পেয়েছে মেয়ে শিশুর ও নারীদের ওপর নানা ধরনের ক্ষতিকর চর্চার বিষয়। 'অ্যাগেইনস্ট মাই উইল’ বা ‘আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ১৯ ধরনের ক্ষতিকর চর্চা বা রীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এসব চর্চা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রচলিত দু'টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সে দুটো হলো বাল্যবিবাহ এবং ছেলে সন্তানের জন্য মেয়েদের প্রতি বৈষম্য।
স্বাভাবিকভাবেই এই করোনাকালীন পরিস্থিতি উঠে আসে প্রতিবেদনে।

ইউএনএফপিএ বলছে, ‘এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়। এটি বন্ধের জন্য বছরের পর বছর ধরে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিশেষ করে কোভিড-১৯–এর প্রেক্ষাপটে এই খাতে অব্যাহত বিনিয়োগ এবং আরও জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এটি সহজেই অনুমেয়, যেকোনো দুর্যোগ এবং সংকটের সময় বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর চর্চার ঘটনা বৃদ্ধি পেতে পারে।’


করোনাকালে বাল্যবিবাহ কী বেড়েছে? আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আখতার বলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জেলা প্রশাসন বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে এটি প্রতিরোধে কাজ করে। তবে করোনার সময় এটি বেড়ে গেছে কি না, তা নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য নেই।’
প্রশ্ন ছিল ইউএনএফপিএর কাছে কোনো তথ্য কি আছে? জবাবে সংস্থার ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ এইকো নারিতা বলেন, ‘তিন মাস
সময় খুব বেশি নয়। এর মধ্যে বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা নির্দিষ্ট করা কঠিন। তবে এমন দুর্যোগের একটি সময়ে এই প্রবণতা বাড়তে পারে।'
প্রতিবেদেন এর আগে তৈরি নানা উপাত্ত দিয়ে বলা হয়, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও শিক্ষা বড় বিষয়। ২০১৭ সালের উপাত্তের উল্লেখ করে বলা হয়, ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয় দরিদ্র পরিবারে। শিক্ষাটা যেমন মেয়ে শিশুর দরকার, তেমনি দরকার বাবা–মায়েরও। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে যারা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তাদের
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। আবার ৭৩ শতাংশের বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে যেখানে মা শিক্ষিত ছিলেন না। আর বাবা শিক্ষিত ছিলেন না এমন পরিবারে বিয়ের ঘটনা ৭৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে।
আজকের অনুষ্ঠানে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেনের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবুও এ সহিংসতা আছে। করোনাকালে এ প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
শিশুশ্রম করোনাকালে বাড়ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল হোসেন বলেন, এ প্রবণতা বাড়তে পারে।
এবার ইউএনএফপিএর  প্রতিবেদেন মেয়ে শিশু ও নারীদের ওপর যে ক্ষতিকর চর্চার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো জেন্ডার-ভিত্তিক লিঙ্গ নির্বাচন বা ছেলে সন্তান নির্বাচনের প্রবণতা।
প্রতিবেদেন বলা হয়, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে এসব ক্ষতিকর চর্চা কমে এলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ পরিচালিত একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে জেন্ডার-পক্ষপাতদুষ্ট লিঙ্গ নির্বাচনের পূর্বশর্তগুলো দৃঢ়ভাবে এখনো রয়ে গেছে।’
ছেলে সন্তান নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রবণতার বিষয়ে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি অসা টর্কেলসন বলেন, এ নিয়ে উদ্বেগ আছে। তবে সুনির্দিষ্ট উপাত্ত নেই।
টর্কেলসন বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই প্রচলিত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুশীলনগুলো পরিবর্তন করে নারী ও মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াতে হবে। বৈষম্যের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।’ 
আজকের অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ইউএনএফপিএর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার (পপুলেশন প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ) মাহবুব ই আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন
সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বেল্লাল হোসেন, ইউএনএফপিএর হেলথ সিস্টেম স্পেশালিস্ট দেওয়ান মো. এমদাদুল হক,
সংস্থার জেন্ডার ইউনিটের প্রধান শামীমা পারভীন প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চলনায় ছিলেন সংস্থার প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট হুমায়রা ফারহানাজ।