সংসদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে মন্ত্রী-সাংসদদের তর্ক-বিতর্ক

জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি
জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর বাজেটে আইন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ নিয়ে সংসদে বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। বিএনপির একজন সাংসদ বলছেন, বিচার বিভাগে স্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতা থাকলে বরাদ্দ দিতে কোনো আপত্তি নেই। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মনে করেন, আওয়ামী লীগের সরকারই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে আইন মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক বসে।

প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ৪২১টি ছাঁটাই প্রস্তাব এসেছে। সংসদের বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৫৯টি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির ৯ জন সাংসদ ছাঁটাই প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে আইন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সাংসদেরা বক্তব্য দেন। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের দাবির বিপরীতে ৯টি করে ছাঁটাই প্রস্তাব এসেছিল।

ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। এখনো নির্বাহী বিভাগের অধীন। উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নির্দেশে বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আজ বলতে দ্বিধা নাই, সারা বাংলাদেশে চিহ্নিত মাদকসম্রাট, চিহ্নিত মাদক পাচারকারী, চিহ্নিত সরকারি সম্পদ আত্মসাৎকারীরা বিচারের আওতার বাইরে। আজ বিচার ব্যবস্থার যে দুরবস্থা, এই দুরবস্থা থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। মিথ্যা মামলায় হাজার হাজার নেতা-কর্মী রাস্তায় ঘুরছেন। পুলিশ বাদী ও সাক্ষী হয়ে যেসব মামলা দিচ্ছে, সেই সব মামলায় বিরোধীদলীয় হাজার হাজার নেতা-কর্মী রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, আদালতে ঘুরছেন, সুপ্রিম কোর্টে ঘুরছেন। এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায়, বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন করতে হবে।’


বিএনপির এই সাংসদ আরও বলেন, ‘সরকারি দলের নেতার বিপক্ষে রায় দেওয়ায় অনেক অধস্তন বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। আমি মনে করি বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন করতে আমাদের স্বাধীনতার আগে যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আমরা পূরণ করার জন্য আইন প্রণয়ন করব। সেই হিসেবে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

এই সময় সরকারি দলের সাংসদেরা প্রতিবাদ করেন। তাঁরা জানতে চান, এর মাধ্যমে তিনি কি পাকিস্তানকে বোঝাতে চাইছেন? তখন হারুন আরও জোর দিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ পাকিস্তান আমল, স্বাধীনতার পূর্বের কথা বলছি।’

পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এর জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ‘আজ তাঁর (হারুনুর রশীদ) আসল চেহারা বেরিয়ে গেছে। তিনি শুধু পাকিস্তানে যেতে চান না। সবকিছু নিয়ে পাকিস্তানে যেতে চান। আমরা সেখানে যাব না। সেখানে ন্যায়বিচার ছিল না। আমরা ন্যায়বিচার দিয়েছি।’

হারুনের পর জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান তার ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর বক্তব্যে দিতে গিয়ে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশ। যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, তাদের বিচারে পরিচালিত হতে চাই না। পাকিস্তানি বিচার আমরা চাই না। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের বিচার ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে চাই।’

বিএনপির সমালোচনা করে পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘জাতির পিতাকে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এ দেশে বিচার বন্ধ করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর এরশাদ ও রওশন এরশাদকে অমানবিকভাবে আটকে রাখা হয়েছিল।’

করোনাভাইরাসের পর ষোড়শ সংশোধনী
জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক (চুন্নু) ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর বক্তব্যে ষোড়শ সংশোধনী মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান। আইনমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই সংসদে আমরা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করেছিলাম। সেই সংশোধনীটা বাতিল করা হয়েছিল। তারপর সরকার আপিল করেছিল। এরপর কী অবস্থা? আমরা জানি না।’

জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সাংসদ না জানলেও তিনি অগ্রগতি জানেন। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়টি রিভিউ পিটিশন হিসেবে আপিল বিভাগে আছে। যখনই করোনাভাইরাস পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে, তখনই শুনানি শুরু হবে।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের জের ধরে তৎকালীন বিচারপতি এস কে সিনহা দেশ ছেড়ে যান। পরে পদত্যাগও করেন।

অন্য সাংসদেরা যা বললেন
বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সামান্য গরু চুরি করে বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে ঘুরতে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা যারা চুরি করছে, তারা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইনে সমতা নেই।’

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, বর্তমানে দেশে যত বিচারপতি রয়েছেন তাঁদের নিয়ে দেশের বিদ্যমান মামলাগুলো ৩০ বছরেও শেষ হবে না।
সংরক্ষিত নারী সাংসদ রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘মামলার জট ৫০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একজন বিচারপতির ওপর ৫ থেকে ১০ হাজার মামলার দায়িত্ব পড়েছে। এই মামলার জট কমাতে হবে।’

আইনমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, মামলা ৩২ লাখের মতো আটকে আছে। বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে।