ঘরে বসে পরীক্ষা, মা-বাবা পরীক্ষকের দায়িত্বে

বাড়িতে বসে মায়ের উপস্থিতিতে পরীক্ষা দিচ্ছে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
বাড়িতে বসে মায়ের উপস্থিতিতে পরীক্ষা দিচ্ছে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

অভিভাবকদের মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার রুটিন। স্কুল থেকে প্রশ্ন তৈরি করে খামে ভরে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রশ্নপত্র ও খাতা (উত্তরপত্র)। আর সেই প্রশ্নপত্র দিয়ে বাড়িতেই নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানদের পরীক্ষা নিচ্ছেন অভিভাবকেরা।

করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে এভাবেই বিশেষ ব্যবস্থায় বাড়িতেই পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গত সোমবার থেকে অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট পরীক্ষা পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি শ্রেণির ছাত্রীদের এই পদ্ধতিতে মডেল টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এতে কোনো পরীক্ষার ফি গ্রহণ করা হচ্ছে না।

জেলার আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নে ১৯৯১ সালে স্থাপিত হয় রাধানগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। বর্তমানে স্কুলটিতে ৩১৬ জন ছাত্রী রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সারা দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নিয়মিত পাঠদান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত চর্চার মধ্যে রাখতেই বাড়িতে বাড়িতে পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নেন শিক্ষকেরা। আর এই সিদ্ধান্তের কথা মুঠোফোনে জানিয়ে দেওয়া হয় অভিভাবকদের। নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে এতে অভিভাবকেরাও সাড়া দেন।

এরপর পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হয় মুঠোফোনের খুদে বার্তায়। প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করে আলাদা খামে ভরে বিনা মূল্যে তা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বাড়িতে পৌঁছে দেন শিক্ষকেরা। প্রত্যন্ত এলাকার অভিভাবকেরা সেই প্রশ্ন সংরক্ষণ করছেন নিজেদের দায়িত্বে।

মুঠোফোনে শিক্ষকদের নির্দেশনায় প্রতিদিন পরীক্ষার সময় খাম থেকে প্রশ্নপত্র বের করে সন্তানদের পরীক্ষা নিচ্ছেন অভিভাবকেরা। রুটিন অনুযায়ী একযোগে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা চলছে পরীক্ষা। নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুল ড্রেস পরে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কেউ ঘরে আবার কেউবা বারান্দায় বসে পরীক্ষা দিচ্ছে তারা। এতে স্কুলের আদলেই পরিদর্শকের ভূমিকায় থাকছেন মায়েরা। পরবর্তীকালে সেই উত্তরপত্র সংগ্রহ করে স্কুলেই মূল্যায়ন করা হবে এবং মুঠোফোনের খুদে বার্তায় অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হবে ফলাফল।

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী তামান্না আক্তার বলে, ‘স্কুল বন্ধ থাকায় আমাদের পড়াশোনার চাপ কমে গেছে। এতে পড়তে বসার আগ্রহটাও কমে গেছে। এখন স্যাররা বাড়িতেই মডেল টেস্ট পরীক্ষা নিচ্ছেন। এখন আগের মতোই পড়তে হচ্ছে। এতে আমাদের পড়াশোনা ঠিক থাকবে।’

অনুপমা রানী নামে আরেক ছাত্রী জানায়, বাড়িতে বসে মডেল টেস্ট পরীক্ষাটা তাদের এসএসসি পরীক্ষার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করবে। মায়ের সামনে বসে তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে ভালোই লেগেছে তার।

বাড়িতে মায়ের উপস্থিতিতে পরীক্ষা দিচ্ছে আরেক ছাত্রী। আটোয়ারীর রাধানগর-মালিগাঁও এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
বাড়িতে মায়ের উপস্থিতিতে পরীক্ষা দিচ্ছে আরেক ছাত্রী। আটোয়ারীর রাধানগর-মালিগাঁও এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

মরিয়ম বেগম নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘পরীক্ষা নেওয়া হবে এই খবর শোনার পর থেকে আমার মেয়ে নিয়মিত পড়ার টেবিলে বসছে। প্রায় তিন মাস ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় ওরা বই খাতা বেরই করতে চাচ্ছিল না। এভাবে পরীক্ষা নেওয়ায় আমাদের মেয়েদের জন্য উপকার হবে।’

রাধানগর মালিগাঁও এলাকার হোসেন আলী নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘করোনায় আমাদের সবকিছুই থমকে গেছে। স্কুল–কলেজ সব বন্ধ। আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ওদের পড়াশোনা প্রায় বন্ধ। এই কঠিন সময়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত আমাদের অনেক ভালো লেগেছে। পরীক্ষাটা বাড়িতে বসে হলেও মেয়েরা কিছুটা চর্চার মধ্যেই থাকবে।’

রাধানগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী বলেন, ‘আমাদের স্কুলটি প্রত্যন্ত এলাকায়। করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন মেয়েরা ঘরবন্দী হয়ে রয়েছে। বিদ্যালয়ে আসতে না পারায় তারা দিন দিন অলস হয়ে পড়ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে পড়াশোনায়। এসব ভেবেই আমরা বাড়িতে তাদের মডেল টেস্ট নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে তারা লেখাপড়াটা নিয়মিত চর্চা করার সুযোগ পায়। প্রাথমিক অবস্থায় অষ্টম শ্রেণির ৬০ জন এবং দশম শ্রেণির ৫০ ছাত্রী এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

পঞ্চগড় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আকতার বলেন, রাধানগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বাড়িতে বাড়িতে পরীক্ষা নেওয়ার এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। করোনার সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চর্চার মধ্যে রাখতে এটি অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।