ফারাজের স্বপ্নের বাস্তবায়ন

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময় অসচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে।  ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময় অসচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে। ছবি: সংগৃহীত

বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সব কার্যক্রম ফারাজের ইচ্ছা ও স্বপ্নের প্রতিফলন।

করোনাভাইরাস নামে এক মহামারি তছনছ করে দিয়েছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ ব্যবসা। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা। ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন এই দুর্দিনে বিপদগ্রস্ত সেই সব মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জাগো ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ছয় হাজারের বেশি মানুষকে দিয়েছে চাল, আটা, ডাল, তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। ফারাজ আইয়াজ হোসেন জীবন দিয়েছিলেন মানবতার জন্য। তাঁর নামে গড়া ফাউন্ডেশনকে কেন্দ্র করে যা হচ্ছে, তার সবই ফারাজের ইচ্ছা ও স্বপ্নের প্রতিফলন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের মানুষ। বহু বিদেশি ওই হামলার শিকার হওয়ায় তার অভিঘাত ছড়িয়ে যায় সারা বিশ্বে। এর মধ্যেও আলো হয়ে ফুটে উঠেছিল ফারাজ হোসেনের নাম। সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। সাহসী এই তরুণের নামে ‘ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন’ গড়েছে তাঁর পরিবার। সেই ফাউন্ডেশন অবিরাম আর্তদের সেবায় কাজ করেছে চলেছে।

করোনাভাইরাসের এই সময়ে খাবারের পাশাপাশি জীবন বাঁচাতে গ্রামাঞ্চলে অক্সিজেন কনসেন্ট্র্যাটর (অক্সিজেন থেরাপিতে ব্যবহৃত যন্ত্র) সরবরাহের কাজ করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনে।

 তরুণ ফারাজ যে এত বড় হয়ে এভাবে বিশ্বে বরণীয় হয়ে উঠবেন, পরিবারের লোকেরা তা কল্পনাও করেননি। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে জাগো ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে একটি ফেলোশিপ প্রোগ্রাম শুরু চালু করেছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। ১ হাজারের বেশি আবেদনকারীর মধ্য থেকে ২০ জনকে নির্বাচন করা হয়েছে। এ তরুণদের নেতৃত্ব শেখানো হবে। দক্ষতা বাড়াতে দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ। ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানে তাঁদের ইন্টার্নশিপেরও সুযোগ দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা করপোরেট নৈতিকতা ও আচরণ শিখতে পারেন।

ডিস্ট্রেসড চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের (ডিসিআই) সঙ্গে কয়েক বছর ধরে চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে আসছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। এই শিবিরের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে আট হাজারেরও বেশি মানুষকে চোখের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে রাজশাহীতে একটি চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। এতে চেকআপ ও ছানি অপারেশনের মাধ্যমে ৯০০ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে।

ফারাজকে নিয়ে সবচেয়ে বড় আয়োজন করে পেপসিকো গ্লোবাল। ২০১৬ সালে তারা প্রবর্তন করে ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার’। আগামী ২০ বছর চলবে এ পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সনদের পাশাপাশি পাচ্ছেন ১০ হাজার মার্কিন ডলার।

ফারাজ হোসেনকে ২০১৮ সালের সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গয়জুয়েতা স্কুল অব বিজনেস। মৃত্যুবরণ করার সময় ফারাজের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার দুই বছর বাকি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তন করেছে ‘ফারাজ হোসেন কোর ভ্যালু অ্যাওয়ার্ড’। ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় ফারাজ হোসেন ও অবিন্তা কবিরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের অক্সফোর্ড কলেজ ক্যাম্পাসে স্থাপন করেছে ‘হোসেন-কবির রুম’। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় মানবিকতার অনন্য নিদর্শন স্থাপনের জন্য ফারাজ হোসেনকে পুরস্কৃত করেছে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, মানবতার কল্যাণে অবদান রাখা মানুষের স্মৃতি রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও স্মৃতিফলক স্থাপন করে থাকে গার্ডেন অব দ্য রাইটার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড। এই উদ্যোগে জড়িত ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইতালির মিলানভিত্তিক অলাভজনক এই সংগঠন ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই পাঁচজন ন্যায়নিষ্ঠ আরব ও মুসলিম ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশে তিউনিসিয়ায় ইতালির দূতাবাসে ‘স্মৃতি-উদ্যান’টি স্থাপন করে। সেখানে ফারাজের নামে স্মৃতিফলক স্থাপন ও একটি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। সেখানে ফারাজ হোসেনই একমাত্র অ-আরবীয়, যিনি এই বিরল সম্মান পেয়েছেন। ইতালির বেনেভোন্তো প্রদেশের রুমো হাইস্কুলে একটি গাছ লাগানো হয় ফারাজের স্মরণে।

অনন্য বন্ধুত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ফারাজ হোসেনকে ভূষিত করা হয়েছে মাদার তেরেসা পুরস্কারে। ভারতের মুম্বাইয়ে পুরস্কারটি নিয়েছেন ফারাজের মা সিমিন হোসেন ও ভাই যারেফ আয়াত হোসেন।

দেশের আনাচকানাচে নানা সংগঠন ও পাঠাগার তাঁকে নিয়ে সভা-সেমিনার করেছে, নানাভাবে স্মরণ করেছে। এর আগে ভারতের শিলিগুড়িতেও ফারাজের নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়েছে। জাগো ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে শিশুশিক্ষা কার্যক্রমসহ নানা ধরনের সহায়তার কাজ করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ চত্বরে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফারাজ চত্বর’। সেখানে রোপণ করা হয়েছে নাগেশ্বর গাছের চারা।

সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনকেন্দ্র সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডে (সিআরপি) চালু হয়েছে ‘ফারাজ হোসেন সেন্টার’। এই সেন্টার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের থেরাপি ও বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে ফিজিও, স্পিচ ও অকুপেশনাল থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন শতাধিক শিশু এই সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠছে। সেন্টারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস লাইফবিষয়ক ডিন জোসেফ মুন, ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক ডগলাস এ হিকস এবং উন্নয়ন ও অ্যালামনাই সম্পর্কবিষয়ক সহকারী ডিন কেভিন স্মিরল।

ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি এসকেএফ টঙ্গীর চেরাগ আলীতে তাদের নতুন কারখানা ভবনের নাম দিয়েছে ‘ফারাজ আইয়াজ হোসেন ভবন’। সেই কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে জীবন রক্ষার ওষুধ।

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন কাজ করছে আর্তমানবতার সেবায়। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। গেল বছর প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে এসে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপকমিশনার আবদুল মান্নান বলেছিলেন, ‘হোলি আর্টিজান হামলায় একমাত্র প্রতিবাদকারী ছিলেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। হামলাকারীরা ফারাজকে বলেছিলেন, তুমি মুসলিম, তুমি চলে যাও। তিনি কিন্তু তাঁর বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে রেখে একা চলে যেতে চাননি। জীবন দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, শান্তি ও সহনশীলতার প্রয়োজনে এ দেশের মানুষ জীবনও দিতে পারে।’