করোনাকালে জঙ্গিরা বসে নেই, চলছে অনলাইনে সদস্য সংগ্রহ

ইউরোপে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের কোভিড-১৯ উপদ্রুত অঞ্চলে ভ্রমণ সতকর্তা জারি করেছিল। তবে সে জায়গা থেকে তারা সরে এসেছে। এখন বলছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে বাহিনীগুলো তাদের দমিয়ে রেখেছিল, তারা এখন চাপে আছে। বিভিন্ন দেশে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংকট আসন্ন। এখন এটাই সুযোগ।

বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এ সময়টাকে জঙ্গিরা কাজে লাগিয়েছে অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের কাজে। সাধারণ ছুটির পর জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মুখপাত্ররা বিভিন্ন এনক্রিপটেড অ্যাপে (গোপনীয়তা নিশ্চিত করা যায় যে অ্যাপগুলোয়) চ্যানেল খুলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

তবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, এ মুহূর্তে বড় কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা তাঁরা দেখছেন না। গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলার পর সিটিটিসি ঢাকার ভেতর ছয়টি এবং ঢাকার বাইরে ১১ জেলায় অভিযান চালায়। গত বছর ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর নব্য জেএমবি হামলা চালালেও আসামিদের গ্রেপ্তার করে ফেলে পুলিশ। আনসার আল ইসলামেরও মাঠে কোনো তৎপরতা নেই।

তা ছাড়া ওই একই সময়ে ১৭টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৯৯৮ জনকে। শুধু লকডাউনের মধ্যেই র‌্যাব জঙ্গি সন্দেহে ৬০ জনের বেশি গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম।

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, জঙ্গিদের আবার পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা আছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রমতে, আইএস বিশ্বব্যাপী হামলার জন্য যে যে পরিস্থিতিকে অনুকূল বলে মনে করছে, বাংলাদেশে তার সব কটিই ঘটতে পারে। সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতাকে পুঁজি করে অনেককে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থও হয়েছে তারা। বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচজন সৌদি আরবে চলে গেছেন। ঢাকা থেকে সৌদি আরবে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার হয়েছেন আরও আটজন। এখনো সাত-আটজন নিখোঁজ। তাঁদের বেশির ভাগ প্রকৌশলী। উসকানিদাতারা তাঁদের বুঝিয়েছেন, কোভিড-১৯ হলো পৃথিবী ধ্বংসের আলামত। তাই এখনই ইমাম মাহাদির অনুসারী হতে দেশ ছাড়া প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‍জঙ্গিবাদ বিষয়টা মনস্তাত্ত্বিক। মহামারিতে ওটা থেমে নেই। যাঁরা ইতিমধ্যেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, মহামারি তাঁদের মাথা থেকে উগ্রবাদকে সরাতে পারেনি। তবে সব সময় যে জঙ্গিরা হামলা ঘটাচ্ছে, তা নয়। এখানে আরও বেশকিছু পক্ষও জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন।

১৯৮৬ সালে মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর উত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা। ১৯৯২ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা চালিয়ে সহিংস উগ্রবাদের সূচনা করে দলটি, ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলা ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলাসহ ১৬টি হামলায় ১৪৫ জনকে তারা হত্যা করে।

>জঙ্গিরা বিভিন্ন অ্যাপে চ্যানেল খুলে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে এখনই বড় হামলার শঙ্কা করছে না পুলিশ।

বর্তমানে তৎপরতা আছে ২০০০ সালের দিকে গঠিত জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ, (যেটিকে পুরোনো জেএমবি বলা হয়), নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হিযবুত তাহরীরের। তৎপর এই চারটি সংগঠনই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ভাবাদর্শ অনুসরণ করে থাকে। ফলে বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশকে ঝুঁকির বাইরে রাখতে চাইছেন না।

পরিকল্পনা কী

আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের মুখপত্র আন নাবা মার্চের শেষভাগে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ আন নাবায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির বিশ্লেষণ করেছে। ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, হামলার লক্ষ্যস্থল হিসেবে আইএসের পছন্দ পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের ভাষায় পশ্চিমের ‌নাস্তিক্যবাদী সরকারের সহযোগিতায় চলা মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। ক্রাইসিস গ্রুপ ৩০টি দেশের ৪৭ জন সদস্যের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মঞ্চ। এই মঞ্চে তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণ করে থাকে। বিভিন্ন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাবেক কর্মকর্তারা এর সদস্য।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রগুলোর দুর্বলতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি থেকে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা বায়োলজিক্যাল এবং কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহারের একটা সুযোগ নিতে পারে।

সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম অবশ্য বলেন, এ মুহূর্তে এ ধরনের কোনো আশঙ্কা তাঁরা করছেন না। তিনি বলেন, আনসার আল ইসলাম সবার অগোচরে বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ধারাবাহিক অভিযানে সেই ক্ষমতা তারা হারিয়েছে।

অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম বাংলাদেশের বাইরের দেশগুলোর জঙ্গি তৎপরতার ওপর নির্ভর করে। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা ও শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিদের মধ্যে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা দেখা গেছে। সেদিক থেকে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান অবশ্য মনে করেন, জঙ্গিদের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সবকিছু জানা যাচ্ছে না। যতদূর ধারণা করা যায়, জঙ্গিরা তাদের কার্যক্রমের ধরন বদলেছে। তারা ডার্কওয়েব ব্যবহার করছে। যেখানে নজরদারির সুযোগ সামান্যই।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগের একটা অংশ বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দুই পক্ষকেই বাংলায় কথা বলতে শুনেছে। আগে শুধু টেলিগ্রাম নামের অ্যাপে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা থাকলেও এখন তাঁরা হুপ ও ট্যামট্যাম নামের অ্যাপে চ্যানেল চালু করেছে। এগুলো পরিচালনা করছেন জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মিডিয়া উইংয়ের লোকজন। তাঁরা নিজেদের তৈরি কনটেন্ট কিংবা বিদেশি ভাষা থেকে অনুবাদ করে বিভিন্ন কনটেন্ট আপলোড করছেন। কার কী প্রতিক্রিয়া দেখে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছেন। কাউকে কাউকে দলভুক্ত করছেন।

জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো প্রচারণার জন্য বেছে নিচ্ছে জনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো। সিটিটিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আনসার আল ইসলামের ১০০টি প্রচারপত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, তার ৩০ ভাগ পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী। ২৫ ভাগ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধী। এ ছাড়া দুর্নীতি, আইনের প্রয়োগহীনতা বা অপপ্রয়োগ নিয়ে ২৫ ভাগ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন–সংক্রান্ত আর জিহাদ ও ধর্মীয় বিষয়ের আলোচনা আছে মাত্র ২০ ভাগ প্রচারপত্রে।

দল ভারী করতে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এমন বিষয়গুলোকে বেছে নিচ্ছে, যেগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত। তারা গণতন্ত্রকে কুফরি বলে মনে করে এবং সরকারের নানা নেতিবাচক দিক তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে থাকে। মহামারিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়েও তারা আলোচনা করছে।

দেশের বাইরে সক্রিয় জঙ্গিরা

পুরোনো জেএমবির মূল কেন্দ্রই এখন ভারত। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালাউদ্দীন সালেহীনের নেতৃত্বে চলা এ দলটির বেশ কিছু নেতা সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারও কারও ভারতে যাওয়ারও নজির আছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নব্য জেএমবির নারী শাখার প্রধান আসমানী খাতুনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁর সঙ্গে ভারতে অবস্থানরত জঙ্গিদের নিবিড় যোগাযোগের প্রমাণ পায় পুলিশ।

সবশেষ মে মাসের শেষভাগে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার হন আবদুল করিম ওরফে বড় করিম। ভারতীয় সংবাদপত্র জানায়, এই করিম জেএমবির রসদ জোগান দেন এবং সালাউদ্দীন সালেহীনের আশ্রয়দাতা।

বাংলাদেশের যেসব তরুণ যুবক আইএসে যোগ দিতে দেশ ছেড়েছিলেন, তাঁদের অনেকে মারা গেছেন। তবে অনেকেই ইরাক, সিরিয়া ছেড়ে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। পুলিশ বলছে, বন্ধুপ্রতিম গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করছে। দেশেও কারও কারও যোগাযোগ আছে। তবে তাঁরা নজরদারিতেই রয়েছেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের জঙ্গিদের যোগাযোগ ছিল। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের জবানবন্দিতে এর উল্লেখ আছে।

কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা জঙ্গিবাদকে উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার হওয়া হোমায়রা নাবিলা একজন প্রভাবশালী জঙ্গি। ১৫ আগস্ট ঢাকার হোটেল ওলিওতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার আকরাম হোসেন খান নিলয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি। হোমায়রা গর্ভবতী হওয়ায় তাঁরা সময় নিচ্ছিলেন। হোমায়রা রাজধানীর একটি বড় বিপণিবিতানের মালিকের মেয়ে।

কাকে জঙ্গি বলা হবে, কাকে বলা হবে না, তা নিয়েও বাহিনীগুলোর মধ্যে বিরোধ আছে। যেমন আল্লাহর দলের বেশ কয়েকজন সদস্য সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের অনেকেই দলটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগে সদস্য ছিলেন। এরপরও গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে বাহিনীগুলোর মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন, এতে করে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে একটি অংশকে।

তারপরও হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার তদন্ত সংস্থা সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশে ভূখণ্ড দখলের মতো অবস্থান নিতে জঙ্গিরা কখনোই সক্ষম হবে না। হামলাগুলো চালাচ্ছে মূলত কট্টর সুন্নিদের একাংশ। বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। তাদের মধ্যে শিয়াদের উপস্থিতি খুবই সামান্য। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি জঙ্গিদের অনুকূলে নেই।