ফুল দিয়ে নিহতদের শ্রদ্ধা নিবেদন

হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের। হামলার চার বছরের মাথায় এবার সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ রাখা হয়নি। পুলিশ, র‍্যাব এবং কয়েকটি দেশের কূটনীতিকেরা শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কাউকে দেখা যায়নি।

হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁটি এখন এর মালিকদের বাসস্থান। গুলশানের লেকপাড়ের দোতলা এই বাড়িটি এখন ছিমছাম, পরিপাটি। জঙ্গিদের নৃশংস হামলা এবং এর পরবর্তী যৌথ বাহিনীর অভিযানের কোনো চিহ্ন আর চোখে পড়ে না। নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটি ছোট স্টেজ বানানো হয়েছিল। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে সশস্ত্র হামলা চালায় পাঁচ জঙ্গি। তখন ছিল রমজান মাসের শেষ পর্যায়। জঙ্গিরা নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশের ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবির, ইশরাত আখন্দ এবং দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, এ উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে রাত কাটে। পরদিন সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেখানে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। সাঁজোয়া যানের ধাক্কা এবং অবিরাম গুলিতে তছনছ হয়ে যায় ভবনটি। অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। অবসান ঘটে প্রায় ১১ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির।

বুধবার সকাল সাড়ে নয়টায় ফুল দিয়ে প্রথম শ্রদ্ধা জানান র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে সফলতা অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ইউনিট কাজ করছে। এক ধাপ এগিয়ে থাকায় জঙ্গিরা যখনই কোনো পরিকল্পনা করছে, তখনই গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী কাজ করে তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে।

নিহত ব্যক্তিদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কূটনীতিকেরা।
নিহত ব্যক্তিদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কূটনীতিকেরা।

এরপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) মোহা. শফিকুল ইসলাম। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে বেশি সময় বাসায় থাকছেন। ধর্মীয় সাইটগুলোতে বেশি ভিজিট করছে মানুষ। এই সুযোগে জঙ্গিরা নিয়মিত করোনার মধ্যেও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। লোন উলফ বা একাকী হামলার জন্য তারা উদ্বুদ্ধ করছে, বিশেষ করে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করার জন্য। কী কী কায়দায় হামলা করতে হবে, একটি হাতুড়ি হলেও সেটি নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করা—এ ধরনের নানাবিধ প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে।

র‍্যাব ও পুলিশের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। এরপর পৃথকভাবে ইতালি ও জাপানের রাষ্ট্রদূত ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। জাপানের রাষ্ট্রদূত ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় পুলিশ সদস্যরা গণমাধ্যমকর্মীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। পরে জাপান অ্যাম্বেসি তাদের ফেসবুক পেজে দুটি ছবি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি জানায়।

পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।
পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।

গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়ক ধরে সোজা পূর্ব দিকে গেলে শেষ মাথায় গুলশান লেকের পাড়ে ৫ নম্বর প্লট। এখানে ২০১৪ সালের জুন মাসে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘হোলি আর্টিজান বেকারি’ এবং ‘ও কিচেন রেস্তোরাঁ’। ভবনটির ওপরের তলায় ছিল বেকারির রান্নাঘর এবং মালামাল রাখার ঘর। আর নিচতলায় বেকারির বিক্রয়কেন্দ্র, রেস্তোরাঁর রান্নাঘর এবং রেস্তোরাঁর অতিথিদের বসার জায়গা। সামনে সবুজ লন। অতিথিদের সংখ্যা বেশি হলে দোতলায়ও বসার ব্যবস্থা করা হতো। লেকপাড়ের সবুজ লনযুক্ত এই বেকারি ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই প্রিয়। খোলা থাকত সপ্তাহের সাত দিনই। শুক্র ও শনিবার সকাল ৮টায় খুলত আর বন্ধ হতো রাত ১০টায়। ওই দুই দিন এখানে সকালের নাশতার ব্যবস্থা থাকত। বাকি পাঁচ দিন খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। বেকারিতে ইতালিয়ান বিভিন্ন ধরনের কেক ও রুটিজাতীয় খাবার আর রেস্তোরাঁয় মূলত স্প্যানিশ খাবার বানানো হতো।

রেস্তোরাঁর সেই সময়ের কর্মীরা জানিয়েছেন, অন্তত ৫০-৬০ জন অতিথি থাকতেন নিয়মিত। অতিথিদের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল স্যামন মাছ, কোরাল মাছ, স্প্যানিশ খাবার পায়লা, কালামার ও গামবাস। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, পিৎজাও খেতেন অনেকে। শুক্র ও শনিবার সকাল থেকেই বিদেশি অতিথিরা আসা শুরু করতেন। অনেকে বাসা থেকে কাপড় বা ম্যাট্রেসজাতীয় কিছু নিয়ে আসতেন। সকালের নাশতার পর লনে তা বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন। তাঁরা দুপুরের খাবার খেতেন। এরপর একেবারে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতেন।

র‍্যাবের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।
র‍্যাবের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।

জঙ্গি হামলার পর প্রায় সাড়ে চার মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে হোলি আর্টিজান প্রাঙ্গণ। ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ মালিককে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। মালিকদের একজন সাদাত মেহেদী আজ প্রথম আলোকে বলেন, রেস্তোরাঁ ভবনটিতে এখন তাঁরাই বসবসা করেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিদেশি কূটনীতিক ছাড়া এবার আর কেউ শ্রদ্ধা জানাতে আসেননি।