আম্পানের ৪০ দিনেও পানিতে তলিয়ে আশাশুনি

পানি ভেঙে ফুলতলা বাজারে কাঁঠাল নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
পানি ভেঙে ফুলতলা বাজারে কাঁঠাল নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

গত ২০ মে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ওই সময় ঝড়–জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় পানিতে তলিয়ে যায় উপজেলার বেশ কিছু এলাকা। তেমনই এলাকা হচ্ছে প্রতাপনগর ইউনিয়ন। আম্পানের ৪০ দিন পেরিয়ে গেলেও প্রতাপনগর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম এখনো পানিতে তলিয়ে রয়েছে। কয়েকটি গ্রাম সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে পানির সঙ্গে বসবাস করা মানুষের দুর্ভোগের চিত্র।

গতকাল মঙ্গলবার সাতক্ষীরা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের প্রতাপনগর, কুড়িকাউনিয়া, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ও মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠ, চিংড়িঘের, পুকুর, পানির আধার সবকিছুই নিশ্চিহ্ন করে উপকূলবাসীকে নিঃস্ব করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। গৃহহীন মানুষজন কবে বাড়িতে ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে, তা কেউ জানে না। ঘূর্ণিঝড় আইলার ক্ষত এখনো শুকায়নি, এর মধ্যেই আম্পানের হামলায় দিশেহারা মানুষ।

গ্রামবাসী জানান, গত ২০ মে আম্পানে জলোচ্ছ্বাসের পর এ ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের সব কটি কমবেশি এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। জোয়ার–ভাটা খেলছে ১১টি গ্রামের ওপর দিয়ে দিনে দুবার করে। কাঁচা ঘরবাড়ি একটিও দাঁড়িয়ে নেই। শ্রীপুর গ্রামে ট্রলারে করে যাওয়ার সময় কোনটি খাল, কোনটি নদী, কোনটি মাছের ঘের আর কোনটি ফসলের খেত, তা বোঝার উপায় ছিল না। সবই পানিতে একাকার। প্রতাপনগর পাকা সেতুটি ভেঙে পড়ে রয়েছে। একই অবস্থা কুড়িকাউনিয়া, শ্রীপুর, সনাতনকাটি, বন্যাতলা, হরিষখালী, চাকলা, কোলা, প্রতাপনগর, রুইয়ারবিল দিখলারআইটসহ গ্রামের পর গ্রাম। প্রতাপনগর ইউনিয়নের পশ্চিমে খোলপেটুয়া নদী আর পূর্বে কপোতাক্ষ নদের মাঝখানে এসব গ্রামগুলো জোয়ারের পানিতে ডুবছে আর ভাসছে।

হরিষখালী এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মেরামত করছেন গ্রামবাসী। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
হরিষখালী এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মেরামত করছেন গ্রামবাসী। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী নাকনা গ্রামের সাহানারা খাতুন (৩৫) বলেন, বাঁধ ভেঙে গেলে এলাকায় বড় কর্তাব্যক্তিরা এসে প্রতিবারই বলে যান টেকসই বাঁধ হবে। কোনো সমস্যা থাকবে না। আম্পানের আগে গত দুই মাসে তিনবার বাঁধ ভেঙে অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। ত্রাণ চেয়ে আগে দ্রুত বাঁধ তৈরির ব্যবস্থা না করলে তাঁদের ঠিকানা–পরিচয় সব হারিয়ে যাবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এভাবে চলে প্রতাপনগর এলাকার মানুষের জীবন, কেউ কথা রাখে না।

শ্রীপুর গ্রামের আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, কপোতাক্ষ নদের পারে মাটির ঘর বেঁধে বাস করতেন তিনি। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে ভেঙে তছনছ হয়ে যায় তাঁর বসতঘর। আইলার পর বেড়িবাঁধ ভেঙে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ঘুরে দাঁড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা চালান তাঁরা। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। আইলার সেই দগদগে ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই আম্পানের আঘাতে আবার তাঁরা জর্জরিত। বেড়িবাঁধ ভেঙেছে, ঘর ভেসেছে, উড়ে গেছে ঘরের চাল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব ভেসে গেছে পানির তোড়ে। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার পানি নেই, খাবার নেই। স্যানিটেশন–ব্যবস্থা একেবারেই নেই। নারীদের মলমূত্রত্যাগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, কখন অন্ধকার নামবে। শ্রীপুর গ্রামের আবুল কাশেম মোড়ল ও জুলফিকার মোল্লা বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বেশ অনেক দিন তাঁদের রোজগার বন্ধ। তারপর আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও শেষ। তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ওপর। কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, তা অনিশ্চিত। বললেন, দ্রুত বাঁধ তৈরির ব্যবস্থা হলে সবাই বাঁচবেন।

কুড়িকাউনিয়া গ্রাম তলিয়ে আছে পানিতে। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
কুড়িকাউনিয়া গ্রাম তলিয়ে আছে পানিতে। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, এ ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার। ২০০৯ সালে আইলার পর থেকে মাটিতে শক্তি কমে গেছে। ফলে বেড়িবাঁধ টেকসই হচ্ছে না।

আইলার পর থেকে প্রায় ৫০০ পরিবার চাকলার উঁচু বাঁধের ওপর বসবাস করছে। তাদের সেই ঠিকানাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে আম্পানে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০ স্থান দিয়ে এ ইউনিয়নে পানি ঢুকছিল। ইতিমধ্যে চাকলায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ হয়েছে। তবে তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারলে আগামী পূর্ণিমায় ভেঙে যেতে পারে।

তিনি জানান, হরিষখালীতে বাঁধের একটি স্থানের মেরামতের চেষ্টা চলছে তিন দিন ধরে। সাত–আট স্থান দিয়ে জোয়ারের সময় পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। আর কত দিন এভাবে ভাসতে হবে আর ডুবতে হবে তা অজানা। সবার আগে টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ চান গ্রামবাসী।

আশাশুনি উপজেলার দায়িত্বে রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নাহিদুর ইসলাম। তিনি জানান, কুড়িকাউনিয়ার বাঁধ নির্মাণ করবে সেনাবাহিনী। আর হরিষখালীর দুটি স্থানে ঠিকাদার কাজ করছে। আর একটি স্থানে ঠিকাদারের সহযোগিতায় স্থানীয় লোকজন রিং বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছে।