একজন ইসাহকের নদী ঘিরে জীবিকা-বসতির গল্প

নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় পুরানপাড়া নন্দুকুঁজা নদীর সেতুর নিচে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বসবাস করেন ইসাহক আলী সরকার। ছবি: প্রথম আলো
নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় পুরানপাড়া নন্দুকুঁজা নদীর সেতুর নিচে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বসবাস করেন ইসাহক আলী সরকার। ছবি: প্রথম আলো

কখনো মাছ শিকার করে, কখনো খেতখামারে কাজ করে সংসার চালাতেন ইসাহক আলী সরকার (৫০)। এক টুকরো জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁইও ছিল। শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে রাতারাতি নিঃস্ব করে দিয়েছে। কোনোরকমে মাছ ধরে সামান্য আয় আর স্ত্রীর ভিক্ষার টাকায় চলছে তাঁর সংসার।

চার মাস আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে ইসাহকের রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। শেষ সম্বল বসতবাড়ির এক কাঠা জায়গা বিক্রির টাকায় চলে চিকিৎসা। পরিবারটি এখন বাস্তুহারা।

তিন মাস আগে পরিবারটি বসতি গড়ে তুলেছে নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় পুরানপাড়া নন্দুকুঁজা নদীর সেতুর নিচে। অস্বাস্থ্যকর আর বৈরী পরিবেশে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন সেখানে। ডিঙি নৌকায় নদীতে মাছ শিকার আর স্ত্রীর ভিক্ষাবৃত্তির টাকায় চলছে তাঁদের জীবন-জীবিকা। তবে চিকিৎসার অভাবে দিন দিন পঙ্গু হয়ে পড়ছেন ইসাহক আলী।

ইসাহক জানান, পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গাড়িষাপাড়া মহল্লায় বসতি ছিল তাঁর। এক কাঠা জায়গার ওপর ছাপরা ঘর তুলে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বাস করতেন সেখানে। কখনো মাছ শিকার করে, কখনো খেতখামারে কাজ করে চলত সংসার। দুই বছর আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছয় বছরের আরেক ছেলে রয়েছে।
মাস চারেক আগে হঠাৎ ডান পায়ের মাংসপেশিতে টান লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েন ইসাহক আলী। অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। ধারদেনা করে শুরু হয় চিকিৎসা। একসময় অবশ হয়ে পড়ে পা। হাঁটাচলা করতে পারেন না। কাজ করার শক্তি হারান। খেয়ে না খেয়ে চলতে থাকে জীবন। নিরুপায় হয়ে বসতবাড়ির জায়গাটি বিক্রি করে চিকিৎসায় ব্যয় করেন তিনি।

ইসাহক আলী বলেন, শরীরে আগের মতো শক্তি নেই তাঁর। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। অনেক কষ্টে পুরোনো একটি ডিঙি নৌকা কিনেছেন। ওই নৌকা নিয়ে নন্দকুঁজা নদীতে জাল ফেলে, বড়শি পেতে মাছ শিকার করেন। দিনে ২০০-৩০০ টাকার বেশি মাছ বিক্রি করতে পারেন না। মাছ বিক্রির টাকায় চলে সংসার। মাছ মিললে উনুন জ্বলে, আর না পেলে না খেয়ে থাকতে হয়। না খেয়ে থাকার কষ্ট লাঘব করতে স্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তি করেন গ্রামে গ্রামে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, সেতুর গাইডওয়ালের পাকা জায়গায় বসতি গড়েছে পরিবারটি। কাঁথা, বালিশ, মশারি, তৈজস রয়েছে সেখানে। ইসাহকের স্ত্রী রমেলা বেগম দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত। আলুর সঙ্গে নদীর ছোট মাছের তরকারি চুলাতে। বড় মেয়ে এসেছে। ছোট ছেলে ইউসুফ পাশের এক শিশুর সঙ্গে খেলাধুলায় ব্যস্ত।
ইসাহক আলীর ভাষ্য, রোদ থাকলে বসবাসে অসুবিধা নেই। তবে ঝড়-বৃষ্টি হলে কষ্টের শেষ থাকে না। পলিথিন টাঙিয়ে বৃষ্টি মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সাপের আতঙ্ক থাকে। তবে সাপের আতঙ্ক তাঁদের খুব একটা কাবু করতে পারে না। কারণ, নদীতে পানি বাড়লেই জাল পেতে মাছ শিকার করা যায়। মাছ পেলেই তাঁদের খাবারের সংস্থান হয়। নদীর দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি কণ্ঠে ইসাহক বললেন, এখন নদী পানিতে টইটম্বুর।
ইসাহক আলীর প্রশ্ন, সরকার খাসজমি, বাড়ি দিচ্ছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা কেন তাঁর দুরবস্থা দেখছেন না? জমি-বাড়ি দূরের কথা, সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আজ পর্যন্ত পাননি। একটু সহযোগিতা পেলে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন তিনি।

পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. সামছুর রহমান পরিবারটির দুরবস্থার তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, পৌরসভার কোনো সহায়তা পায়নি পরিবারটি। তবে ইসাহককে সরকারের খাসজমিসহ বাড়ি দেওয়ার জন্য সহমত প্রকাশ করেন ওই কাউন্সিলর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন মুঠোফোনে বলেন, বিষয়টি জানা নেই তাঁর। খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেন জানান তিনি।