করোনার সংক্রমণ রোধে ওঁরা ১৪ জন
এপ্রিল মাসে পিরোজপুর সদর উপজেলার দাউদপুর বাজারে প্রবেশ করলে সচেতন যে কেউ ধাক্কা খেতেন। মানুষের চলাচল দেখে বোঝার উপায় ছিল না, পুরো বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশও আজ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে টালমাটাল। সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে বাজারে মানুষের ভিড়। মুখে মাস্ক নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
এ অবস্থা দেখে স্থানীয় তরুণ মো. রানেল হাওলাদার (২৬) ভাবলেন, মানুষকে সচেতন করতে কিছু একটা করা দরকার। তাঁর একার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তিনি এলাকার ১৪ জন তরুণ-যুবককে নিয়ে গঠন করলেন স্বেচ্ছাসেবক দল। গত ১৬ এপ্রিল দলটি দাউদপুর বাজারে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সচেতনতামূলক প্রচার চালায়। তারা কাঁচাবাজার ও মাছবাজারে দূরত্ব তৈরি করে দেয়। মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করে। এরপর তারা ছড়িয়ে পড়ে পুরো কলাখালী ইউনিয়নে। গ্রামের মসজিদগুলোতে জীবাণুনাশক ছিটানো, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করতে ৮১ দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে দলটি। একদল তরুণ-যুবকের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ স্থানীয় লোকজনের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এখন হাটবাজারে অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন। মেনে চলছেন সামাজিক দূরত্ব। উদ্যোগটি অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে পুরো কলাখালী ইউনিয়নে।
মো. রানেল হাওলাদার জানান, ১৩ এপ্রিল পিরোজপুর জেলায় প্রথম এক ব্যক্তির করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তখনো মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা লক্ষ করা যায়নি। হাটবাজারে ঘেঁষাঘেঁষি করে কেনাবেচা চলেছে। মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন না অনেকে। এ অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে ১৫ এপ্রিল রাতে বন্ধুদের নিয়ে বসেন রানেল। সিদ্ধান্ত নেন, দাউদপুর বাজারে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাবেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। রানেলের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখান কয়েকজন তরুণ ও যুবক। পরদিন সকালে আগ্রহী ১৪ জনকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন রানেল।
রানেলের দল প্রথমে দাউদপুর বাজারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য মাছ ও কাঁচাবাজার স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রসংলগ্ন মাঠে স্থানান্তর করে। সেখানে প্রতিটি স্টল ছয় ফুট দূরত্ব রেখে বসিয়ে দেওয়া হয়। মাইকিং করে করোনাভাইরাস রোধে করণীয় ও সতর্কতা বিষয়ে প্রচার চালায়। এরপর মাস্ক ব্যবহারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। যাঁদের মাস্ক নেই, তাঁদের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করে। তাদের কাজ দেখে অনেকে এগিয়ে আসেন। কেউ ঢাকা থেকে মাস্ক কিনে পাঠান। কেউ হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস কিনে দেন। এরপর তারা স্থানীয় পথের হাট, রাজারকাঠি, কলাখালী বাজারে কাজ করে। হাটবাজারে কাজ শেষে দলটি নেমে পড়ে গ্রামে। পাড়া–মহল্লা ঘুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালায়। দরিদ্র মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করে। গ্রামের মসজিদগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করে।
রানেল ছাড়াও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা অন্যরা হলেন মো. রুমান হাওলাদার (২৩), শুভ কাজী (২২), ফয়সাল সরদার (২২), সজীব তালুকদার (১৯), শাকিল খান (১৮), রাশেদুল ইসলাম (১৭), কামাল হোসেন (১৮), রিফাত হোসেন (১৭), জসীম হাওলাদার (২৮), তমিজুল খান (২৫), মারুফ হোসেন (২০), সাব্বির হোসেন (১৮) ও হৃদয় আহমেদ (২৪)।
শুভ কাজী বলেন, ‘প্রথমে নিজেরা চাঁদা দিয়ে কাজ শুরু করি। পরে আমাদের কাজ দেখে এক ব্যক্তি ঢাকা থেকে ১৫০টি মাস্ক কিনে পাঠান। স্থানীয় এক ব্যক্তি দেন আরও ১০০টি মাস্ক। এ ছাড়া আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে মাস্ক কিনে বিতরণ করেছি। জীবাণুনাশক স্প্রে করছি।’
দাউদপুর বাজারের ব্যবসায়ী সাইদুল শেখ বলেন, ‘আমরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে অতটা জানতাম না। স্থানীয় কিছু তরুণ-যুবক আমাদের বোঝালেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে সামাজিক দূরত্ব রেখে কেনাবেচা করতে হবে। মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। এরপর থেকে আমরা এগুলো মেনে চলছি। তরুণ–যুবকদের উদ্যোগটি আমার ভালো লেগেছে।’
পিরোজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বশির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ওই স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের ব্যাপারে আমি অবগত আছি। বিশেষ করে দাউদপুর বাজারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে তাঁদের কাজ প্রশংসিত হয়েছে। একটি বাজারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজটি অনুকরণীয়।’