এ উদ্বেগ মৃত্যুর আর ভালোবাসার

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
হাসপাতালে লেখক।
হাসপাতালে লেখক।

২০ রমজান (১৫ মে) সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বুঝলাম, শরীরে হালকা জ্বর। এমন জ্বর যা অগ্রাহ্য করা যায়। দুপুরের পর থেকে জ্বর কমেও গেল। রমজানের সময়টায় টানা বাসায় থেকে কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্যই এ রকম হতে পারে বলেই মনে হলো।
রাতে আবারও জ্বর এল। এবার কিছুটা বেশি। প্যারাসিটামল খেলাম। বুঝতে পারছিলাম শরীরটা দুর্বল হচ্ছে। তখনো মনে চিন্তা আসেনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারি।

কারণ, অ্যাজমার সমস্যা থাকায় বেশ কিছুদিন ধরে বাসা থেকেই অফিসের কাজ করছিলাম। এমনকি বাজার-সওদাও পরিচিতদের দিয়ে আবার কখনো অনলাইনে অর্ডার করে করা হচ্ছে। বাসার গেট থেকে কেয়ারটেকার আবার সেসব ফ্ল্যাটের দরজায় দিয়ে যাচ্ছেন।

১৭ মে, রাত থেকে স্ত্রী আলসিবা প্রিয়াংকারও জ্বর এল। ওর জ্বর আমার চেয়ে বেশি। শরীরের দুর্বলতা বাড়তে থাকায় সেদিন আর রোজা রাখতে পারলাম না আমরা। রাতে প্রিয়াংকার জ্বর আরও বাড়ল।

পরদিন থেকে আমাদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা শুরু হলো এবং দুর্বলতা বেড়েই চলেছে! একটা সময় এমন হলো বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়াতেই কষ্ট হচ্ছিল। এরই মধ্যে আমার বুকে ও গলায় চাপ অনুভব করছি। মনে সন্দেহ দানা বাঁধল!

আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন দিলাম। তারা বলল, এ সময় অনেকেরই ডেঙ্গু হচ্ছে। ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা করাসহ আরও কিছু পরামর্শ দিলেন তাঁরা।

এরই মধ্যে সহপাঠী বন্ধু স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মিজান রহমানের পরামর্শে কিছু ওষুধ খাওয়া শুরু করেছি। মিজান সব সময়ই স্বাস্থ্যগত যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে আসে। করোনাকালীন পুরো সময়টাই সে পাশে ছিল!

২০ মে, বাসার পাশেই ফরাজি হাসপাতালে গেলাম। চিকিৎসক বুকের এক্স–রে, ডেঙ্গু ও রক্তের কিছু পরীক্ষা দিলেন এবং কোভিড পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। মনে মনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিলাম। তাঁরা এখনো পুরোদমে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

২১ মে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনেকটা নিরিবিলি পরিবেশে দুজনই কোভিড পরীক্ষার জন্য নমুনা দিলাম। ওই দিনই ডেঙ্গু পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এল। সেই সঙ্গে ভয়টা আরও বেড়ে গেল।

২৩ মে সকাল থেকে মাথাব্যথার তীব্রতা বাড়ছিল, শরীর আরও দুর্বল হচ্ছিল। আত্মবিশ্বাস ছিল, আমাদের করোনা হবে না, আমরা অনেক দিন ধরে ঘরেই আছি!

তবে আমাদের বিশ্বাস ভাঙচুর করে দুপুরের পর খবর পেলাম, দুজনই কোভিড পজিটিভ! এটা যে কত বড় একটা ধাক্কা, যাঁরা এই সময়টা মোকাবিলা করেছেন তাঁরাই জানেন! মনে হচ্ছিল মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

দুজনের পরিবারের কয়েকজনকে জানালাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপমহাপরিচালক (বার্তা) অনুপ কুমার খাস্তগীর ও প্রধান বার্তা সম্পাদক মুন্সী ফরিদুজ্জামানকে জানালাম। তাঁরা মনে সাহস রাখতে বললেন। জানালেন, সর্বক্ষেত্রে পাশে থাকবেন।

প্রধান বার্তা সম্পাদকের পরামর্শে সন্ধ্যায় কথা বললাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামানের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বললেন, মনে সাহস দিলেন, ওষুধ ঠিক করে দিলেন। পরবর্তীকালে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত এই চিকিৎসক বড় ভাইয়ের মতো পাশে ছিলেন!

২৪ মে সকাল থেকেই আমাদের শরীর আরও খারাপ হচ্ছিল! সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। রাতে কয়েকবার শ্বাসকষ্ট হয়েছে। বুকে, পিঠে প্রচণ্ড চাপ। সকাল থেকে প্রিয়াংকার বমি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পাতলা পায়খানা।

আমরা হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে রওনা দিলাম। ইতিমধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন অনুপ কুমার খাস্তগীর৷ আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। পথিমধ্যেই ফোন দিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক এস এম হারুন-অর-রশিদ। যিনি মাত্রই পুরো পরিবারসহ কোভিডমুক্ত হয়েছেন। তিনি অভয় দিলেন। পাশে থাকার কথা জানালেন।

হাসপাতালে লেখকের স্ত্রী।
হাসপাতালে লেখকের স্ত্রী।

হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি হওয়া নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলো। বিটিভির মহাপরিচালক, উপমহাপরিচালক কথা বলছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও অন্যদের সঙ্গে। ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন অন্য সহকর্মীরাও। শফিউল্লাহ সুমন তো পারলে সকাল থেকেই আমাদের বাসার সামনে অ্যাম্বুলেন্স এনে রাখে। সকাল থেকেই বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করছিলেন। আরেক সহকর্মী সুজন হালদার সমানে ফোন দিচ্ছেন এবং নেতৃস্থানীয় অনেককে দিয়েই হাসপাতালে ফোন করিয়েছেন। আরও অনেকে নানাভাবে সহযোগিতা করছিল।

কিছুক্ষণ পর ফোন দিলেন একাত্তর টেলিভিশনের হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ। যিনি ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের (বিজেসি) সদস্যসচিব।

মাত্রই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কিছু সিট সংরক্ষণ করা হয়েছে টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো ও বিজেসির উদ্যোগে।

শাকিল ভাই জানালেন, তাঁরা ভর্তির ব্যবস্থা নিচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হলো কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা।

আমাদের কাছে কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট নেই। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে ফল জেনেছি। শুধু পরীক্ষার ল্যাব আইডি আছে। ফলাফল মোবাইলে এসএমএস আসতে আরও কদিন লাগবে কে জানে!

মনে হচ্ছে, এ নিয়ে আরেক জটিলতা শুরু হবে। ফোন দিলাম পূর্বপরিচিত ডাক্তার রেজওয়ানুল করিম শামীম ভাইকে। যিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত করোনা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের যুগ্ম সদস্যসচিব। তাঁকে জানানোমাত্র জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজনের ফোন নম্বর দিলেন। সেখানে বলার ১০ মিনিটের মধ্যেই আমার হোয়াটসঅ্যাপে রিপোর্ট এল। অবশেষে আমাদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হলো!

হাসপাতাল পর্ব
হাসপাতালের লম্বা করিডর পেরিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমরা দোতালায় উঠেছি। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন একজন। দেখে মনে হলো কোনো ডর-ভয় নেই, বরং আমরাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছি। দোতলায় বাঁ পাশে একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা কর্নারে বেশ কিছু কেবিন গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য সংরক্ষিত। সামনের ২ বেডের একটি কেবিন আমাদের দেওয়া হলো। মাত্র পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। কেবিনে ঢুকে আমরা গা এলিয়ে দিলাম।

কিছুক্ষণ পর ফোন দিলেন শাকিল ভাই। জানালেন, আমরাই প্রথম তাঁদের ব্যবস্থাপনায় এখানে ভর্তি হলাম। তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। পরবর্তীকালে তিনি প্রায়ই ফোন দিয়ে সবার খোঁজখবর নিতেন।

ভাবনায় ছিল ডাক্তার-নার্সরা কেমন সেবা দেবেন। এত দিন গণমাধ্যমে হাসপাতালের বিভিন্ন খবর শুনে আমরাও কিছুটা ভীত ছিলাম। সন্ধ্যায় নার্স এসে ওষুধ ঠিক করে দিয়ে গেলেন। আমাদের পাশের রুমই নার্সেস স্টেশন। জানালেন ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজন মনে করলেই যেন জানাই। কথাবার্তায় একধরনের আন্তরিকতা আছে, আমরা আশ্বস্ত হলাম।

রাত বাড়ল, আমরা খাবার শেষে ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে উঁকি দেওয়া ঈদের চাঁদ ইতিমধ্যে মধ্যাকাশে মিলিয়ে গেছে।

আমার বেশ ভালো ঘুম হলো, তবে প্রিয়াংকার সারা রাত ঘুম হয়নি বমি বমি ভাবের কারণে।

সকালবেলায় দরজায় নক করল একজন। আপাদমস্তক পিপিই পরে থাকা কে ডাক্তার, কে নার্স আর কে ক্লিনার—আলাদা করার উপায় নেই। দরজা খুলতেই একজন বলল, নিচে যেতে হবে। আমরা তার সঙ্গে এক্স–রে করার জন্য নিচে গেলাম। একটু পর পরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে এলেন একজন।

কিছু সময় পর ডাক্তার ভিজিটে এলেন। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন। সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। ইসিজি করার জন্য একজন এলেন। সকাল থেকে বেশ ব্যস্ত সময় কাটল।
দুপুরের খাবারে পোলাও-মুরগির রোস্ট দেওয়া হয়েছে।

মনে পড়ল আজ ঈদের দিন! বুদ্ধি হওয়ার পর এই প্রথম ঈদের নামাজ পড়া হলো না আমার। বহু বছর আগে আমার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে একা একা ঈদ করেছিল আমার বড় বোন। তখন আমার বয়স ছয় বছর!

হাসপাতালের ব্যালকনিতে হেঁটে হেঁটে বাগানে ফোটা বাহারি ফুল আর খোলা আকাশ দেখে বিকেলের অনেকটা সময় কাটালাম। হাসপাতালের পশ্চিম পাশের এই বিল্ডিংটা একেবারেই ফাঁকা। কেবিন, ওয়ার্ডগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রোগী আসবে, প্রচুর রোগী আসবে।

পরদিন রাত বারোটার দিকে হঠাৎ ফোন এল। প্রিয়াংকার বড় বোনের স্বামী সিরাজুল ইসলামের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি আগে থেকেই হার্টের রোগী। দ্রুত রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু ভর্তি নেওয়া হলো না। আরও বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে শেষে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলো। সেখানেও ভর্তির জটিলতা। পরে অনেক চেষ্টায় ভর্তি করা হলো। অক্সিজেন দেওয়া হলো। তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। রাত তিনটার দিকে ডাক্তার জানালেন, তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭২–এ নেমে গেছে।

কোভিড চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েছেন এই দম্পতি।
কোভিড চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েছেন এই দম্পতি।

জরুরিভাবে আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে বেড খালি নেই। আইসিইউর ইনচার্জ জানালেন, একজন মারা গেলে তবেই আরেকজনকে নেওয়া সম্ভব। এত রাতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া হচ্ছিল কিন্তু কোথাও আইসিইউতে সিট নেই। আমরাও বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছিলাম। শেষে ধানমন্ডির সিটি হসপিটালে আইসিইউ বেড পাওয়া গেল। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা গেলেন।

পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তাঁর মরদেহ দেওয়া হলো। পরে অবশ্য পরীক্ষায় তাঁর করোনা নেগেটিভ এসেছিল। অথচ সময়মতো হাসপাতালগুলো ভর্তি নিল না।

সারা রাত আমাদের নির্ঘুম কাটল। সকালে ডাক্তার ভিজিটে এলে প্রিয়াংকা কান্না করতে করতে এক ঘণ্টার জন্য বাসায় যাওয়ার অনুমতি চাইল। এই মিনতি দেখে ডাক্তারের নীরবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কীই–বা করার ছিল!

ইতিমধ্যেই আমাদের কর্নারে অনেকেই ভর্তি হয়েছেন৷ বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপসম্পাদক মাহমুদ হাসান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, ৭১ টেলিভিশনের নিউজ প্রেজেন্টার আফসানা শাওন, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান স্যারের স্ত্রী নাঈম আরা হোসেন, এটিএন নিউজের প্রয়াত সিইও কে এম ফিরোজের স্ত্রীসহ আরও কয়েকজন। দূরত্ব রেখেও আমরা পরিবারের সদস্য হয়ে উঠছিলাম।

আস্তে আস্তে রোগী বাড়ছে। এই ভাইরাস মনে হয় কাউকে ছাড়বে না। আগের রাতে পাশের কেবিনে একজন মারা গেলেন। মাত্র এক দিন আগে এসেছেন। পরিচয় জানা হলো না, এর আগেই মারা গেলেন।

আমাদের করোনার উপসর্গ কমে যাচ্ছিল। কিন্তু মানসিকভাবে তখনো বিপর্যস্ত। প্রিয়াংকা ফোনে অনবরত কান্না করে যাচ্ছে। নার্সরা এসে বোঝাচ্ছে, এ রকম করলে শরীর আরও খারাপ হবে। কিন্তু এভাবেই চলছিল।
বিটিভির মহাপরিচালক, উপমহাপরিচালক প্রতিদিনই ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রধান বার্তা সম্পাদক ফোন করে মনে সাহস দিচ্ছেন।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪-৫ দিন পর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানিয়েছি। এরপর থেকেই পরিচিত, স্বল্প পরিচিত, দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকা অনেকেই নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ অকপটে ফোন দিচ্ছেন। কেউ ফেসবুক পোস্ট দেখে ফোন দেবেন কি না ভেবে ভেবে শেষে ফোন দিচ্ছেন।

আমাদের দুজনের পরিবারের লোকজনকে একটু পরপরই জানাতে হচ্ছে শরীরের উন্নতি-অবনতি সম্পর্কে।

বাড়িওয়ালা আন্টি প্রতিদিন ফোন দিচ্ছেন। বাসার কেয়ারটেকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে দোয়া করছেন। ফেসবুক পোস্টের কমেন্টে, ম্যাসেঞ্জারে, মোবাইলের এসএমএসে পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য মানুষের সুস্থতা কামনার বার্তা পাচ্ছি।

করোনায় আক্রান্ত না হলে তো এই ভালোবাসা বোঝা যেত না। সহজে ঘৃণা ছড়ানোর এই যুগে, হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ এই জীবনে করোনা ছোবল না দিলে তো এই সুপ্ত ভালোবাসার প্রগাঢ় প্রকাশ কখনোই দেখা যেত না। আমাদের নিয়ে চারপাশের পরিচিত মানুষেরা সবাই উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ মৃত্যুর, এই উদ্বেগ ভালোবাসার!

১ জুন পরীক্ষার জন্য আবার নমুনা দিলাম আমরা। এবার অপেক্ষার পালা। ইতিমধ্যেই হাসপাতালে রোগী ভরে গেছে। আমাদের কর্নার থেকে আর বের হচ্ছি না। কেবিনেই সময় কাটছে। কখনো জানালার পাশে বসে আমরা পাখি দেখছি, ভেড়াদের ঘাস খাওয়া দেখছি, কখনো রাস্তায় ছুটে চলা চলন্ত গাড়ি দেখছি। আর অপেক্ষা করছি একটা টুংটাং শব্দের!

৫ জুন রাত ১২টার দিকে দুজনের মোবাইল একসঙ্গে বেজে উঠল। প্রিয়াংকা চিৎকার করে উঠল। আমাদের দুজনেরই রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মুক্তির নেশায় ছটফট করেই আমাদের রাতটা কেটে গেল।

পরদিন সকালে ডাক্তার আসতেই জানালাম, আমাদের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। ডাক্তার রিলিজের বন্দোবস্ত করতে বললেন।

আমরা কেবিন গোছাতে লাগলাম। এ কদিনে কেবিনেই আমাদের ছোট্ট সংসার গড়ে উঠেছে। সেই সংসার আমরা সানন্দে গুটিয়ে নিচ্ছি।

পাশের কেবিনে পরিচিতজনদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, নার্সদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম! এত দিনে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সবার সঙ্গে। তারপরেও এই বিচ্ছেদে সবাই খুশি।

লম্বা প্রশস্ত করিডর পেরিয়ে আমরা হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছি। মেইন গেটে গিয়ে এত দিন পর সত্যিকারের খোলা আকাশ পেলাম, মুক্ত বাতাস পেলাম। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়ালাম। দূরে কোথাও একটি কোকিল কুহু কুহু শব্দে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে!

আমরা বাসার দিকে ছুটে চলেছি। অর্ধশত মাইল বেগে তীব্র বাতাস আমাদের ওপর উপচে পড়ছে। আমরা বুক ভরে নির্মল অক্সিজেন নিচ্ছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি প্রিয়াংকার চোখের কোণে জল! এই জল আনন্দের, এই জল স্বজন হারানোর!

* লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ টেলিভিশন। [email protected]