একাকী কষ্ট, নিভৃত কান্না

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কত দিন হয়ে গেল বাসার বাইরে বের হই না! আমি এমন এক মানুষ, যে কখনোই কাজ থেকে অবসর চাইনি। মুহূর্তের জন্যও নয়। সর্বক্ষণ চেয়েছি ব্যস্ত থাকতে। কাজের সমুদ্রে নাক ডুবিয়ে রেখেছি। সেই আমি যে কীভাবে ঘরের কোণে এতটা সময় কাটিয়ে দিলাম, নিজেই ভেবে পাচ্ছি না। শুনতে পাচ্ছি, সব স্কুল-কলেজ নাকি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখার আশঙ্কা আছে।

নিজের সঙ্গে নিজে মুখোমুখি হয়ে কীভাবে এত দিন আমার ভেতরের পাথরের ভার বহন করতে পারব, জানি না।

আমি একটা বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। শিক্ষকতার কাজ শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে যায়। বিকেলে প্রাইভেট টিউশনি করাই। এরপর বাসায় এসে টুকটাক অনলাইনে কিছু কাজ করি। এভাবেই নানা কাজের মধ্যে কেটে যাচ্ছিল আমার প্রতিদিনের জীবন। নিজেকেই নিজে নানা কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে এসেছি। ভেবেছি, প্রতিদিনের এমন ব্যস্ততায় জীবনটা কেটে যাবে আমার। ছুটির কথা মাথায় আনিনি। করোনা আমার জন্য নিয়ে এল অবসরের ঘোর বিপত্তি।

অনেকে হয়তো ভাবছেন, কেন এত ব্যস্ততার মধ্যে নিজের জীবনটাকে গুঁজে দিয়েছি। সে কথা জানতে একটু পেছনে ফিরতে হবে। প্রথম যখন দেখলাম প্রথম আলোতে পাঠকের লেখা ছাপা হচ্ছে, মনে হলো এই অবসরে নিজের মনের কথা বলি। মনের ভার একটু হালকা করি। প্রতিদিন এই জায়গায় কত কত পাঠকের কত বিচিত্র লেখা পড়ছি। অনেকেই লিখছেন তাঁদের অবসর উদ্‌যাপনের গল্প, অনেকে লিখছেন পরিবারের সঙ্গে মধুর সময় কাটানোর কথা, কেউ লিখছেন তাঁর ব্যক্তিগত আনন্দের বর্ণনা। কিন্তু আমার জীবন তো এমন নয়। আমার চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। অনেক সংকোচ নিয়ে ভেবেছি, এভাবে নিজের কথা লিখলে সবাই কী ভাববে? পরে অসম্ভব সাহস নিয়ে লিখতে বসলাম।

আমার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। এ ধরনের বিয়েতে জানাশোনার যে কত ফাঁক থেকে যায়। বিয়ের পর আমি এবং আমার অভিভাবকেরা জানতে পারলাম, বিয়ের আগে আমার স্বামী একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। সে দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল তাঁর মাথার ও শরীরের। সেটুকু শুনে ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি, আরও কঠিন ও নির্মম কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আরও পরে জানতে পারলাম, কখনোই আমরা সন্তানের মা-বাবা হতে পারব না। বিয়ের মতো একটা নিবিড় সম্পর্ক রচনা করতে গিয়েও যে মানুষ সত্য লুকিয়ে রাখতে পারে বা নীতি বিসর্জন দিতে পারে, সেটি ছিল আমার বা আমার অভিভাবকদের কল্পনারও বাইরে।

আমি একটা কোটরের মধ্যে ঢুকে গেলাম বিয়ের পর। তৈরি করে নিলাম নিজের মতো একটা পৃথিবী। কাজে মুখ গুঁজে মনের গহিনে লুকানো কষ্ট আড়াল করে রাখার চেষ্টা করলাম। এভাবেই চলছিল জীবন। যাঁদের আমার পাশে দাঁড়ানোর দরকার ছিল, তাঁদের কখনো পাশে পাইনি। বুঝতে পেরেছি, আদতে এটা আমার একার লড়াই। একাই লড়তে হবে। একাই জীবনের বাকি দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে। আমার সে যুদ্ধে আমার পরিবার, ভাই, ভাইয়ের পরিবার আমার মনের শক্তি উজ্জীবিত রাখতে সব সময় সাহায্য করেছে।

করোনার অখণ্ড অবসর আবার আমার ওপর সেই ভারী পাথরের ওজন চাপিয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে নিজে বেঁচে থাকার লড়াই করছি। আমি হাঁসফাঁস করছি কাজের বিপুল স্তূপের নিচে নিজেকে সঁপে দেওয়ার অপেক্ষায়।

করোনাকালে সবাইকে আমরা মানবিক হতে বলছি। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে নীতির উন্মেষ ঘটাতে না পারলে কীভাবে আমরা সত্যিকারের মানবিক হতে পারব!