সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য কম খরচের ভেন্টিলেটর তৈরি

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীদের তৈরি ইমার্জেন্সি মেডিকল ভেন্টিলেটর। ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীদের তৈরি ইমার্জেন্সি মেডিকল ভেন্টিলেটর। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একদল শিক্ষার্থী কম খরচে দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘ইমার্জেন্সি মেডিকেল ভেন্টিলেটর’ তৈরির দাবি করেছেন। কোভিড–১৯-এ আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীদের শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখতে এই ভেন্টিলেটর উপকারে আসবে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় রুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (ইইই) বিভাগের হলরুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভেন্টিলেটরটি প্রদর্শন করা হয়। রুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের ২৫ জন শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে গঠিত ‘দুর্বার কান্ডারী’ দল ভেন্টিলেটরটি তৈরি করেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘দুর্বার কান্ডারী ইমার্জেন্সি ভেন্টিলেটর’। এই দলের তত্ত্বাবধান করেছেন ইইই বিভাগের অধ্যাপক মো. মাসুদ রানা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থী তাঁদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন।

দুর্বার কান্ডারী দলের শিক্ষার্থীরা জানান, করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্র আক্রমণ করে। এতে আক্রান্ত কোনো কোনো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। তখন ওই রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারেন না। এই অবস্থায় ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে রোগীর ফুসফুসে অক্সিজেন প্রদান ও কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে এনে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখা হয়। রুয়েট শিক্ষার্থীদের এই ভেন্টিলেটর তৈরি করতে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কেনার জন্য প্রায় ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি তৈরিতে আদর্শ ভেন্টিলেটরের মান অনুসরণ করা হয়েছে। তবে ভেন্টিলেটরটিকে অ্যাডভান্সড লেভেলে নিতে আরও কিছু কাজ করতে হবে।

অধ্যাপক মাসুদ রানা জানান, গত মার্চ মাসের শেষের দিকে রুয়েটের কিছু শিক্ষার্থী মিলে ‘দুর্বার কান্ডারী’ দল গঠন করেন। তবে সাধারণ ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সে সময় সবাই বাড়িতে ছিলেন। তাই প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা অনলাইনে সংযুক্ত হতেন। কাজের সুবিধার জন্য শিক্ষার্থীদের মেকানিক্যাল, হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার দলে ভাগ করা হয়। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ স্থানে থেকেই নিজেদের কাজ করেছেন। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় একপর্যায়ে তাঁদের সবার কাজ রুয়েটে পাঠানো হয়। এরপর রুয়েটের একটি ল্যাবে সেগুলো নিয়ে কাজ করা হয়।

অধ্যাপক মাসুদ রানা বলেন, কোভিড–১৯ চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) দেওয়া ইমার্জেন্সি মেডিকেল ভেন্টিলেটরের মডেল অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা এই ভেন্টিলেটরটি বানিয়েছেন। তাই এই ভেন্টিলেটরটি মূলত কোভিড–১৯ রোগীদের ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এটির নির্মাণব্যয় কম রাখা সম্ভব হয়েছে।

ভেন্টিলেটর তৈরির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা জানান, তাঁদের তৈরি ভেন্টিলেটরটি ম্যানুয়াল এবং অ্যাসিস্ট কন্ট্রোল মোডে কাজ করে। এতে বিভিন্ন গোলযোগে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ১১ ধরনের অ্যালার্ম ব্যবহার করা হয়েছে। চিকিৎসকদের ব্যবহারের জন্য একটি ওয়েব অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে চিকিৎসকেরা দূরে থেকেই রোগীদের সব তথ্য পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারবেন। ব্যবহারকারীরা স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে ভেন্টিলেটর নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

অধ্যাপক মাসুদ রানা বলেন, ‘আমাদের দেশে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং ভেন্টিলেটরের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। করোনাভাইরাসের জন্য জরুরি প্রয়োজনে বাইরে থেকে ভেন্টিলেটর আমদানি করাও সহজ নয়। আর বিদেশ থেকে ভেন্টিলেটর আনতে গেলে প্রতিটির জন্য ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। আমাদের এই ভেন্টিলেটর দেশে উৎপাদন করা হলে খরচ অনেক কম হবে।’

দুর্বার কান্ডারী দলের সদস্য ও ইইই বিভাগের ১৫ সিরিজের (শেষ বর্ষ) শিক্ষার্থী মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা নিজেদের প্রকৌশলের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোভিড–১৯ পরিস্থিতিতে চলমান চিকিৎসাসংকটে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি।’

রুয়েটের উপাচার্য রফিকুল ইসলাম সেখ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এক মাসের মধ্যে এই ভেন্টিলেটরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হবে। এটি চিকিৎসা খাতে ব্যবহারের জন্য সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন। বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সব ভেন্টিলেটর তৈরির সক্ষমতা আমাদের নেই। তবে কেউ চাইলে আমরা চুক্তির মাধ্যমে তাঁদের এই ভেন্টিলেটর উৎপাদনের সুযোগ দিতে পারব। আমাদের প্রত্যাশা, এই ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেন্টিলেটর–সংকট সমস্যার সমাধান হবে।’

যন্ত্রকৌশল বিভাগের ১৫ সিরিজের (শেষবর্ষ) শিক্ষার্থী মো. রাফি উদ্দিনের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে রুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. সেলিম হোসেন, পরিচালক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিয়া মো. জগলুল সাদত, গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. শামীম আনোয়ার, ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের উপপরিচালক মো. মামুনুর রশীদ ও আবু সাঈদ, রুয়েটের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. মকসেদ আলী, দুর্বার কান্ডারী দলের সদস্য মো. রাফিউল ইসলাম, মো. মাহমুদুল হাসান, ওয়াসিফ আহমেদ, রাফি রহমান, মো. রাফি উদ্দিন, মো. মাশরুর সাকিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।