ভালো কাজ করে বিপাকে ইউএনও

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেয় মাগুরার শালিখা উপজেলা প্রশাসন। এলাকার তরুণদের নিয়ে গঠন করা হয় স্বেচ্ছাসেবক দল। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি নানা রকম সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয় দলটি। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন, এখন পর্যন্ত উপজেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার সীমিত থাকার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে এসব উদ্যোগ।

সম্প্রতি শালিখার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের নামে বিএনপি-জামায়াতকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। দল গঠনে জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ নেননি। এই অভিযোগসহ তানভীর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নয়টি অভিযোগ দিয়ে বদলির আবেদন জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন উপজেলার নয়জন জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় সাংসদের সুপারিশ করা ওই চিঠির পর মঙ্গলবার বদলির আদেশ এসেছে।

জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি কোনো শাস্তিমূলক বদলি নয়। জনপ্রশাসন থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখানে আমাদের করণীয় কিছু নেই।’

তবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি সহায়তার বিভিন্ন কর্মসূচির তালিকা তৈরিতে স্বচ্ছতা আনতে ও অনিয়ম দূর করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় জনপ্রতিনিধিদের রোষানলে পড়েছেন ইউএনও তানভীর রহমান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, জমি আছে ঘর নেই ও কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ পরিস্থিতির জন্য বিশেষ মানবিক সহায়তা কর্মসূচির তালিকা তৈরিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থান নেন ইউএনও তানভীর রহমান। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তালিকায় অনেক অসংগতি ধরা পড়ে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে একজন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে ফেব্রুয়ারি মাসের ভিজিডির চাল পাওয়ার পর ইউএনও তাঁকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন সমন্বয়ক প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যাঁরা ছুটিতে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। দলমত-নির্বিশেষে সবাই কাজ করেছেন। ঈদের পর থেকে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যখন আমরা কাজ করেছি, তখন তো কোনো চেয়ারম্যানরা অভিযোগ করেননি। জেলায় যেখানে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই শ ছাড়িয়েছে, সেখানে শালিখায় এ পর্যন্ত মাত্র ১৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এখানে বিএনপি-জামায়াতের লোক দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।’

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার বিষয়ে ইউএনও প্রথমে চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে তালিকা নেন। তাঁরা প্রায় ২১ হাজার মানুষের তালিকা দেন। সেখানে শালিখার বাসিন্দা নয় বা অস্তিত্বহীন বহু মানুষের নাম পাওয়া যায়। পরে চেয়ারম্যান, মেম্বার, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক ও গ্রাম পুলিশের সহায়তায় ৯ হাজার ৫০০ জনের তালিকা তৈরি করে উপজেলা প্রশাসন।

একই রকম ঘটনা ঘটেছে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, জমি আছে ঘর নেই প্রকল্প ও সরকারের অন্যান্য সুবিধাভোগীর তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেও। উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, এসব ক্ষেত্রে আগে জনপ্রতিনিধিরা যে তালিকা দিতেন, সাধারণত সেই তালিকা অনুযায়ী কার্ড দেওয়া হতো। ইউএনও তানভীর রহমান স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য বিধি মোতাবেক মাইকিং করে ইউনিয়ন পরিষদে সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক উন্মুক্ত যাচাই–বাছাই সম্পন্ন করে তালিকা তৈরি করেন।

বিভিন্ন ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পের প্রতিটি উপকারভোগীর তালিকা তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই–বাছাই করেছেন। শালিখার আড়পাড়া ইউনিয়নের এক অংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন আমাদের সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের তালিকা দিয়েছে। সেগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা যাচাই করে পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট বিভাগে দাখিল করেছি।’

ইউএনও তানভীর রহমানের বিরুদ্ধে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বিল ও ওভারল্যাপিংয়ের মাধ্যমে পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্পের বিল উত্তোলনের অভিযোগও দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। এ বিষয়ে তানভীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা ফার্নিচার, ল্যাপটপসহ যে পণ্যের ভুয়া বিলের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো আমার অফিসে বিদ্যমান। আর প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটি মাসিক সভায় অনুমোদন করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, প্রাক্কলন তৈরি করেন উপজেলা প্রকৌশলী, আর বিল উত্তোলন করে বাস্তবায়ন করেন সংশ্লিষ্ট পিআইসি (জনপ্রতিনিধি)। কোনো ভুল হলে পরবর্তী মাসিক সভায় সেটি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। অভিযোগকারীরা মাসিক সভায় উপস্থিত ছিলেন। ওভারল্যাপিং হলে তাঁরা অবশ্যই আপত্তি দিতেন।’

ইউএনও তানভীর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর ৭ জুলাই শালিখায় আসেন খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) সৈয়দ রবিউল ইসলাম। এ বিষয়ে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতির অভিযোগ করেননি চেয়ারম্যানরা। মূল অভিযোগ ইউএনও তাঁদের বাদ দিয়ে নিজেই সব তালিকা করেছেন।