তিস্তাপারের দুঃখগাথা

তিস্তায় বন্যার পর শুরু হয়েছে নদীভাঙন। ভাঙনের শিকার মানুষ টিনের চাল, বেড়া, আসবাব সব নিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে এলাকা ছাড়ছেন। গত মঙ্গলবার হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়নের মোস্তাক মোড়ে।  ছবি: প্রথম আলো
তিস্তায় বন্যার পর শুরু হয়েছে নদীভাঙন। ভাঙনের শিকার মানুষ টিনের চাল, বেড়া, আসবাব সব নিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে এলাকা ছাড়ছেন। গত মঙ্গলবার হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়নের মোস্তাক মোড়ে। ছবি: প্রথম আলো

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ২৬৭টি পরিবারের বাস। সেখানে জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার। বছরের তিন-চার মাস এই মানুষগুলোকে বন্যার পানিতে থাকতে হয়। এই তথ্য জানালেন ইউপি সদস্য এবাদত আলী। তিনি ২০ বছর ধরে এ ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি।

গত মঙ্গলবার বিকেলে ইউনিয়নের দোয়ানী সাধুর বাজারে কথা হয় এবাদত আলীর সঙ্গে। এ সময় ছয়আনি গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার বর্ষায় তাঁর বাড়িতে এখন পর্যন্ত তিনবার পানি উঠেছে। তাঁরা চলাচল করছেন নৌকা দিয়ে।

গত রোববার রাতে তিস্তা ৩০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সোমবার সকাল থেকে পানির চাপ কমতে শুরু করে। গতকাল বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত একই পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হয়েছে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে। অব্যাহত পানি কমতে থাকায় বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে তিস্তাপারের বাসিন্দারা।

বন্যাকবলিত জনপদ

উত্তর-পশ্চিম থেকে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম হয়ে। উজানে পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণ শুরু হলে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে তিস্তাপারে বন্যা শুরু হয়। সব থেকে বেশি বন্যার কবলে পড়ে হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিংগীমারী, সিন্দুরনা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ।

গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী এলাকাটিতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প। তিস্তার বাঁ তীর ঘেঁষে ব্যারাজের উজানে একটি ও ভাটিতে নয়টি ওয়ার্ড। ইউনিয়নটি বেশি বন্যাকবলিত বলে জানালেন এখানকার বাসিন্দারা। 

তিস্তা ব্যারাজের পেছনে দোয়ানী চেকপোস্টের পশ্চিমে নদীর পাশে ও তীরে বাস করে ১৮০ পরিবার। তাদের ঘরবাড়ি থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে ক্ষত রয়ে গেছে। বুধবার সকালে তিস্তার স্রোতে ঘর-আঙিনা থেকে সরে যাওয়া মাটি ঠিক করছিলেন সেখানকার আশেদা বেগম। তিনি বলেন, ‘বান আসলে জানপ্রাণ নিয়া বাঁধে উঠি। পানি নামলে বাড়ি ফিরি। মেলা সময় হঠাৎ পানি বাড়ে, কিছু নিবার পাই না।’

তিস্তার বাঁ তীর রক্ষা বাঁধ না থাকায় বন্যার পানি কমলেও ইউনিয়নের চরগড্ডিমারীর বাসিন্দাদের কয়েক মাস পানিবন্দী থাকতে হচ্ছে। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম জানান, বাঁ তীর ঘেঁষে দোয়ানী থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার ওয়াপদা বাঁধ আছে। কিন্তু তার ভাটিতে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নেই। এতে তিস্তার পানি ঢুকে সানিয়াজান নদের পানির সঙ্গে মিশে এই এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

বারবার বন্যায় দিশেহারা

বাংলা বছরের জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চার-পাঁচ দফা বন্যার কবলে পড়েন তিস্তাপারের বাসিন্দারা। উজানের পানির ঢলের সঙ্গে বালু আসায় তিস্তার চরাঞ্চলে কমে গেছে চাষাবাদ। কৃষক ছয়ফুল ইসলাম জানান, মাঘ-ফাল্গুন মাসে তিস্তার নিচু জমিতে বোরো ও উঁচু জমিতে ভুট্টার চাষ হয়। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে বা আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহে বন্যা এলে বেশির ভাগ ফসল তলিয়ে যায়।

জেলা রেড ক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন বলেন, তিস্তায় আকস্মিক বন্যা বেশি হওয়ায় মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম। চলতি বন্যায় তাঁর বাড়িতে পানি উঠেছিল। পানি কমে যাওয়ার পর কিনারে বসে তিস্তার শান্ত রূপ দেখছেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে।  ছবি: প্রথম আলো
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম। চলতি বন্যায় তাঁর বাড়িতে পানি উঠেছিল। পানি কমে যাওয়ার পর কিনারে বসে তিস্তার শান্ত রূপ দেখছেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে। ছবি: প্রথম আলো

ত্রাণ বরাদ্দ কম

তিস্তাপারের বাসিন্দারা বলছেন, তাঁরা সরকার থেকে তেমন ত্রাণসহায়তা পান না। বছরে চারবার বন্যা হলে ত্রাণ পান একবার। অনেকে তা-ও পান না। দোয়ানী চেকপোস্ট এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব নেছার উদ্দিন বন্যার কবলে পড়লেও কয়েক বছর ধরে ত্রাণ পান না। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে আর ত্রাণ চান না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সাহায্য চাইলে দেয় না। তাই চাওয়াই বাদ দিছি।’

অপ্রতুল ত্রাণ বরাদ্দের কথা স্বীকার করলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। গড্ডিমারী ইউপির একজন সদস্য বলেন, তাঁদের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক হাজার পরিবার। বুধবার ত্রাণ পেয়েছে ১৮০টি পরিবার। বরাদ্দ কম হওয়ায় বন্যাকবলিত বেশির ভাগ মানুষ ত্রাণ পায় না।

ত্রাণ বরাদ্দে ভাগ পাচ্ছেন ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও। বরাদ্দ করা ত্রাণের নির্দিষ্ট অংশ ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। গড্ডিমারী ইউপি চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও তাঁর ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ডের দুই হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৮০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ১৩০টি পরিবারকে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রফিকুল আলম খান বলেন, প্রতিবারই সরকারি ত্রাণ বিতরণে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তাই বণ্টনব্যবস্থা স্বচ্ছ হওয়া উচিত।

 ভাঙছে তিস্তা

সোমবার ভোরে বন্যার পানির প্রবল চাপে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ-ভারত শূন্যরেখা অংশের বাঁ তীর ভেঙে গেছে। এতে নদীর পানি ঢুকে দহগ্রামের সরদারপাড়া সড়কের ছয়টি অংশ ভেঙে যায়। দহগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন জানান, সড়ক ভেঙে যাওয়ায় সরদারপাড়া, বলের বাড়ি, কলোনির তিন গ্রামের সঙ্গে দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

মঙ্গলবার বিকেলে গড্ডিমারী ইউনিয়নের মোস্তাক মোড়ে গিয়ে দেখা গেল, নদীভাঙনের শিকার হয়ে বাড়িঘর নৌকায় নিয়ে এসেছেন তিস্তার ওপারের ছাতুনামা চরের বাসিন্দা সেফালী বেগম। তিনি বলছিলেন, তাঁরা আগেও তিনবার নদীভাঙনের কবলে পড়েছিলেন। তখন অন্য চরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার অন্য কোথাও জায়গা না পেয়ে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেবেন।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, জেলার তিস্তা ও ধরলা নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটারের মতো এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ১৭টি স্থানে জরুরিভাবে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, জেলার বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৪২২ মেট্রিক টন চাল ও ২২ লাখ ২৫ হাজার ৭০০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে তিন হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, লালমনিরহাট ও পাটগ্রাম]