করোনাকালের অমানিশি জন্মদিন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে প্রতিটি মানবপ্রাণের আবির্ভাব ঘটে ব্যতিক্রম কিছু সৃষ্টির জন্য। কিন্তু অধিকাংশই তার সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত না করেই এই ধরণি থেকে বিদায় নেয়। অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে, নিরর্থক মানুষ অতীতে ফিরে যেতে চায়! জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডই মহামূল্যবান, কারণ তা আর কখনই ফিরে আসে না। তাই তো মানুষ কর্মবিমুখিতার স্মৃতির অতলগহ্বরে হারিয়ে যায়। তাই বোধ হয় প্রায় সব মানুষের জীবনই অনেকটা একই রকম মনে হয়, কিন্তু তা হওয়ার কথা নয়!

অন্যদিকে কর্মচঞ্চলদের কাজের বাঁকে নানা ধরনের ভুল, মানুষমাত্রই হয়। ব্যতিক্রমী চিন্তাকর্মের মাধ্যমে বাস্তব প্রকাশই মানবজন্মের সার্থকতা। কারণ এই দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্মক্ষণ তো দূরের কথা, বছর-মাস-তারিখের হিসাবই ঠিক নেই। যাদের আছে, তাদের আবার অধিকাংশের প্রকৃত জন্মতারিখ সনদের সঙ্গে গোলমাল! এভাবেই পার হয় জীবনের বহমান অর্ধশত বছরের গোলমেলে জীবন!

‘বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়’ বাণীটি ধারণ করে অগত্যাই অনেকে বেঁচে থাকে। যদিও চলার পথে অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত নানা দুর্ঘটনায় ছন্দ পতনে থমকে যায় জীবন বারবার। অনেকেই হতাশার তিমিরে হরহামেশই তলিয়ে যায়। কেউবা শক্তি আর সাহস সঞ্চয় করে দ্বিগুণ গতিতে আবার ছুটে চলে..., তাই তো তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবে খুব বেশি গরমিল হয় না, ‘সেলিম বুঝে’র, মতোই…! তাই হয়তো, অবুঝ মন ভাবে, সঠিক পথেই তো চলছে জীবন। এই ব্রত ধারণ করেই, কর্মের মধ্যে অমর হওয়ার বাসনায়, জীবনের আঁকাবাঁকা বন্ধুর দুর্গম পথে, ছন্দ-বর্ণ-স্বপ্ন ও গতিময় ৫১টি ষড়ঋতু অনেকের হয়তো সুচিন্তার স্বপ্নের বীজ বুনেই পার করে…

অনেকের দম ফেলার সময় হয় না এমন ব্যস্ত জীবন, তাই হয়তো তাদের নিঃসঙ্গতায় ভুক্তে হয় না কখনোই, কর্মজগৎই হয় জীবনের নিত্যসঙ্গী। তাই তো পাওয়া না–পাওয়ার হিসাব মিলিয়ে দেখার সময় হয় না খুব একটা! এভাবেই একই আবর্তে ঘুরপাক খায় অর্ধশত বছরের মানবজীবন! পরিপক্ব বুদ্ধিমত্তা ও গতি উভয় থাকে মানুষের এই বয়সেই। এ বয়সেই জীবনের স্থিরতা আসে। তাই তো পৃথিবীকে নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু দেওয়ার সময় হয় কিন্তু দেশের পঞ্চাশোর্ধ্বের মানুষ করোনায় আক্রান্তের অতি ঝুঁকিতে, জেনেবুঝে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। তবু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই কাজটাই অবলীলায় করতে হচ্ছে মানুষকে, তাই তো এখন অনেকেই হুটহাট করেই না–ফেরার দেশে চলে যাচ্ছেন! দেশ ইতিমধ্যে অনেক অমূল্য প্রাণ হারিয়েছে, যা সংখ্যা দিয়ে বিবেচ্য বিষয় নয়।

করোনায় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অবাধ চলাচলের সহজগম্যতা অবরুদ্ধ করে দিয়েছে, জীবনের চলার পথে নানা কঠিন জটিল ধাঁধা স্বাভাবিকভাবেই সামনে দৃশ্যমান। অনিশ্চিত পথে অন্তহীন দুশ্চিন্তায়, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ জট বেঁধে একাকার! এই কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছে স্থবির মানবজাতি! অনেকের মনে হয়, কোন অদৃশ্য জীবনঘাতী অণুজীব সব সময় তাড়া করেছে, মস্তিষ্ক খাবলে ধরে রেখেছে কোন কিট! অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ ও বায়ুদূষণে চমকে চমকে ওঠে মন, মাথার মধ্যে অনুভূত হয় সর্বক্ষণ হাতুড়ি পেটার শব্দ! এখন প্রতি দিবস ও রজনীর ক্ষণে অমানিশার অন্ধকার নিশিতে নিজের ছায়াকে অপরিচিত মনে হয়। ভালো লাগে না কিছুই, সব নিষ্ফল মনে হয়।

এই বিশ্বমারি মহামারির মধ্যেও কেউ ভালো নেই। একটা দিন পার করা মহা কষ্টের..., সামাজিক জীব হিসেবে মানব প্রজাতিকে এভাবে দীর্ঘদিন চলা সত্যই দুরূহ! এখন প্রতিটি ভোর হয় আতঙ্কের, রাত হয় নির্ঘুম যন্ত্রণার! বিশ্বমারি করোনাকালের মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অমানিশার অন্ধকারে দিন তারিখ সময় বার সব যাচ্ছে ভুলে মানুষ! এভাবেই ঘোরের মধ্যে একঘেয়েমি জীবন কেটে যায় জীবনের নিয়মেই, বৈচিত্র্যহীন জীবন তবু থেমে থাকে না...!

ঐতিহাসিক মাতৃভাষার গৌরবময় সংখ্যা ৫২'তে পদার্পণের দিনে, অবরুদ্ধ একজন সমাজকর্মী, সমাজবিচ্ছিন্নতার অনুভূতি, দাউদ হায়দারের কবিতার মতোই, ‘জন্মই যেন আজন্ম পাপ…!’ এখন বেঁচে থাকায় নিদারুণ যন্ত্রণা! এভাবে কোনোমতে মূল্যবোধহীন জীবন বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী! যদি মানবিক মন হতে সৃজনশীলতাই মরে যায় ‘কর্মহীন জীবন হতাশার কাফনে জড়ানো একটি জীবন্ত লাশ’। এই কর্মহীন অমানিশার হতাশার তিমিরের বুকচিরে, চির সংগ্রামী এই জীবন, ৫২–তে এসে আবার নতুন রূপে গতি ফিরে পাবে, না করোনায় থমকে দেবে জীবনের গল্প! তা, কে জানে। ভাগ্যনির্ভর জুয়া খেলার অনিশ্চিত জীবন, সংগ্রামী মানুষদের জন্য নয়।

হে মানব! যখন, হাত-পা-মাথাবিহীন, জ্ঞান-বুদ্ধিহীন ক্ষুদ্র শুক্রাণু ছিলে। তুমি তখনো ৩০ কোটির অধিককে পিছে ফেলে দৌড়ে বিজয় অর্জন করেই তোমায় হতে হয়েছিল প্রকৃতির মানবসন্তান। এভাবেই বিন্দু হতে সিন্ধু হয়ে আবার অণুতে বিলীন হয় মানুষ, থাকে শুধু লেখা, কথা ও কাজ। জন্মসূত্রেই বলে দেয় সুকর্মময় গতিই জীবন...। তাই বোধ হয় মানুষ তার জিনগত মৌলিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারে না। পারে না, ভাগ্যের লিখন খণ্ডাতে। তবে, অবশ্যই নেতিবাচক বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচকে বিকশিত করতে পারে। তাই ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’—এই আশায় জীবন বাজি রেখে ভালো কাজের সন্ধানে, জন্ম–জন্মান্তর স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতার কাটা...! এই চলার পথের শেষ কোথায় তা কেউ জানে না! এই তো করোনাকালের জীবনে অমানিশি জন্মদিন!

*লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, এইড ফাউন্ডেশন