বেতন নেই, প্রাইভেট-টিউশনিও বন্ধ, ঋণ করে চলছে সংসার

জাহাঙ্গীর আলম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক। মাসে বেতন পান সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া কিছু ছাত্রছাত্রীকে ব্যাচে পাড়াতেন। পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বাসায় গিয়ে করতেন টিউশনি। সব মিলিয়ে মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পেতেন। এতেই মোটামুটি সংসারের খরচ মিটে যেত তাঁর। কিন্তু করোনার কারণে মার্চ থেকে তাঁর সবই বন্ধ রয়েছে। এখন ঋণ ও জমানো টাকায় চলছে সংসার।

শুধু জাহাঙ্গীর আলমই নন, এটি জেলার সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরই দুরবস্থার চিত্র। জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষক আছেন অন্তত ৯০০। আর কর্মচারী রয়েছেন ২০১ জন। করোনার কারণে জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের তিন মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাচ পড়ানো ও টিউশনিও। আর্থিক অনটনে শিক্ষকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় ৭টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এমপিওভুক্ত ৩৪টি, নন–এমপিওভুক্ত ২টি ও ১২টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি কলেজ রয়েছে ৩টি, এমপিওভুক্ত কলেজ ৩৩টি, এমপিওবিহীন কলেজ ৪টি ও ৬টি বেসরকারি কলেজে রয়েছে। জেলায় ১৮৭টি মাধ্যমিক ও ২৫টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে এমপিওভুক্ত ২০৮টি, এমপিওবিহীন ২৪টি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৩টি। এর বাইরে ৬৪টি এমপিওভুক্ত ও ১৯টি এমপিওবিহীন মাদ্রাসা রয়েছে। আর কিন্ডারগার্টেন রয়েছে ৮৭টি।

বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাড়া করা ভবন নিয়ে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি কোনো ধরনের অনুদান পায় না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফি ও ভর্তির ফি থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ ও কর্মরত শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করা হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ বিদ্যালয়ের মাসিক আয় থেকে আগে নিজের জন্য আয়ের একটা পরিমাণ কেটে নিয়ে যান। অবশিষ্ট অংশ থেকে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় খরচ মেটাতে হয়। একই অবস্থা জেলার কিন্ডারগার্টেনগুলোতেও।

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ১৭ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যে কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায় করতে পারছে না। এ জন্য জেলার বেসরকারি ও নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ মার্চ মাস থেকেই শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না। এ কারণে সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার করোনার এই সময়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আবার এমপিওভুক্ত কোনো কোনো কলেজ কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষকদের বেতনের ১০ শতাংশ কর্তনের ঘোষণাও দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু জেলার স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আশুগঞ্জ সার কারখানা স্কুল, আশুগঞ্জ সার কারখানা কলেজ, আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইউনাইটেড কলেজসহ আরও এক-দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ করোনার এই মহামারির সময়েও তাদের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা দিয়ে যাচ্ছে।

অন্তত ১৪ জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, শিক্ষকেরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প বেতন পান, যা দিয়ে তাঁদের পরিবারের খরচ কোনোভাবেই মেটানো সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই প্রাইভেট পড়ানো ও টিউশনি করতে হয়। মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাড়া নেওয়া ভবনের ভাড়া প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠানের কোনো আয় নেই। এতে হিমশিম খাচ্ছে মালিকপক্ষ।

গত ১৮ মে জেলার প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফোরাম কর্মহীন হয়ে পড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সুদবিহীন ঋণ প্রদানসহ পাঁচ দফা দাবিতে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। পরে ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তার আওতায় জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নন–এমপিওভুক্ত ১ হাজার ৯৭ জন শিক্ষকের মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা এবং ২০১ জন কর্মচারীকে আড়াই হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়।

দীপঙ্কর তালুকদার নামের এক কলেজশিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, যা একজন শিক্ষক মজবুত করেন। অথচ চার মাস ধরে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো বেতন পাচ্ছি না। প্রাইভেট ও টিউশনিও বন্ধ। ঋণ করে পরিবারের খরচ চালাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে অবশেষে দিনমজুরের কাজে নামতে হবে।’

জেলার প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফোরামের সভাপতি অধ্যক্ষ সোপানুল ইসলাম ও সদস্যসচিব অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল বলেন, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা বেতন থেকেই বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষকসহ জনবলের বেতন, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করতে হয়। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে আংশিক বা পুরোপুরি কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা পায় না। তাই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য সুদবিহীন ঋণ এবং অনলাইন, মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে প্রতিষ্ঠানের মাসিক টিউশন বেতন আদায়ের অনুমতিসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়।