দুর্দিনেও কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক

ধানের দাম পেয়ে খুশি কৃষকেরা। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বারঢালি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
ধানের দাম পেয়ে খুশি কৃষকেরা। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বারঢালি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

আকাশে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি। কাস্তের টানে খেতের মুঠি মুঠি ধান কেটে চলছে শ্রমিকের দল। তারই মাঝে মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধান মুখে তুলে উড়ে যাচ্ছে কবুতরের ঝাঁক। পাকা ধানের ম–ম গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ।

মেঘ-বৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে সূর্য যখন তপ্ত রোদ ছড়ায়, শ্রমিকের দেহ তখন খানিকটা দম নিতে চায়। দম নেওয়ার ফুরসত পেয়েই শ্রমিকেরা মেতে ওঠেন গালগল্পে। শ্রমিক আহসান আলী বলছিলেন করোনা আর ধানের বাজারদর নিয়ে। তিনি বলেন, ‘করোনায় সব মানুষলার মরণ দশা। তবে যা কহ কৃষকলা কিন্তু টাকা পাছে।’

আহসান আলীর কথা কেড়ে নিয়ে গোবিন্দ নারায়ণ বলে ওঠেন, ‘মহাজনক কহিবা হবে, শুধু ধান কাটার মজুরি দিলেই হবেনি। ভালোমন্দ খিলাবাও হবে।’ মজুরির পরও ভালো-মন্দ খাওয়াতে হবে, এমন জিজ্ঞাসায় শ্রমিকেরা সমস্বরে বলে উঠলেন, করোনার খারাপ সময়ের মধ্যেও কৃষক এবার ধানের দাম পাচ্ছেন। কথা শুনে পাশেই দাঁড়ানো কৃষক খসিউর রহমান হাসলেন। মাথা নেড়ে শ্রমিকদের আবদারে সায় দিয়ে তিনি বললেন, ‘খাওয়াব, অবশ্যই খাওয়াব।’

করোনা পরিস্থিতিতে দেশের জনজীবন, শিল্প-অর্থ-বাণিজ্য—সবকিছুতে একধরনের স্থবির দশা। মানুষের মধ্যে হা-হুতাশ। এসবের মধ্যেও ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক। অন্য বছর কষ্টের ফসল বাজারে নিয়ে দাম শুনে হতাশ হলেও এবার করোনা পরিস্থিতিতেও ফসলের দাম ভালো পাওয়ায় তাঁদের মুখে হাসি।

ধানের পাশাপাশি গম ও ভুট্টার দামও বেড়েছে
গতবার আমনে ৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে লাভ তো দূরে থাক, উৎপাদন খরচই ওঠাতে পারেননি সদর উপজেলার ভেলাজানের কৃষক আবদুল গনি। লোকসানের কারণে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে এ বছরের বোরো মৌসুমে তিনি দুই বিঘা কম জমিতে ধান আবাদ করেন। লোকসানের শঙ্কা থাকলেও তিনি করোনাকালে বাজারে ধানের ভালো দাম পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গত আমনে পাঁচ বিঘা জমির ধান বিক্রি করে যে দাম পেয়েছিলাম, এবার দুই বিঘা কম জমিতে ধান আবাদ করে তার চেয়ে বেশি টাকা পেয়েছি। ধানের দাম পেয়ে এবার পাঁচ বিঘা জমিতেই ধান আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছি।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৫৮ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এতে ফলন হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন ধান। আর গত বছর ৬২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ করে ফলন হয়েছিল ২ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ মেট্রিক টন ধান। সে সময় প্রতি মণ ধানের দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা হলেও এবার কৃষকেরা সেই ধানের দাম পাচ্ছেন ৮০০ টাকা।

দেশের সর্বোচ্চ গম উৎপাদনকারী জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে গত বছর ৫২ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে গম আবাদ হলেও এ মৌসুমে আবাদ হয়েছে ৫০ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। গত মৌসুমে ২ লাখ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। এই মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮৫ মেট্রিক টন। গত বছর কৃষকেরা প্রতি মণ গম ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করলেও এ মৌসুমে পেয়েছেন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা।

তবে ভুট্টা আবাদ ও ফলনের চিত্র একটু ভিন্ন। জেলায় গত বছর ৩০ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদ হলেও এবার ৩৪ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। আর ফলন হয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৭ মেট্রিক টন। গত বছর কৃষকেরা প্রতি মণ ভুট্টার দাম ৩৫০ টাকা পেলেও এবার পাচ্ছেন ৫০০ টাকা।

গত বছর ৭ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হলেও চলতি মৌসুমে আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৮৮৫ হেক্টরে। গত বছর ফলন হয়েছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৬৩ মেট্রিক টন। এ বছর হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৪১ মেট্রিক টন। গত বছর প্রতি কেজি সবজি বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়।

খেতে বসেই ধান বিক্রি
ঠাকুরগাঁও-বালিয়াডাঙ্গী আঞ্চলিক সড়কের বারঢালী এলাকার একটি মাঠে ধান কাটছিলেন জনা দশেক শ্রমিক। পাশেই দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছিলেন কৃষক আতাউর রহমান। তিনি ওই ব্যক্তিকে বিদায় জানিয়ে শ্রমিকদের তাগাদা দিতে দিতে উৎফুল্লচিত্তে বলতে লাগলেন, ‘তাড়াতাড়ি ধান কাটো। সব ধান বিক্রি হয়ে গেছে।’ কে কিনল, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওই লোকটাই ধানের পাইকার। প্রতি মণ ধান ৮০০ করে কিনে নিয়েছেন।’

কৃষক আতাউর জানালেন, গত বছর এই সময়ে হাটে নিয়েও ধান ৪০০ টাকায় বিক্রি করা যায়নি। এবার পাইকাররা খেতে থেকেই দ্বিগুণ দামে ধান কিনে নিচ্ছেন।

১০ বছরের মধ্যে দাম সর্বোচ্চ
হঠাৎ আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেল। তা দেখে শুকাতে দেওয়া ধান ঢেকে দিতে ছুটলেন কৃষকেরা। ধান ঢাকা শেষ হলে আশ্রয় নিলেন একটি ছাপরা ঘরে। একটু পর শুরু হলো বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মধ্যে গল্প জুড়ে বসলেন কৃষক আজহারুল ইসলাম। ধান নিয়েই তাঁর গল্প। তিনি বললেন, একসময় এলাকায় কত জাতের ধান হতো। ধানের নানা বাহারি নাম মুগ্ধ করত মানুষকে। উচ্চফলনশীল ধানের দাপটে মাত্র কয়েক যুগে সেই ধানগুলো অতীত হয়ে গেছে। এবারের বাজার নিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধান আবাদ করে লস খেয়েছি। এইবার ধানের বাজার ভালো। করোনায় ধানের দাম না পাইলে কৃষককে না খেয়ে মরতে হতো।’

পাশে দাঁড়িয়ে আজহারুলের কথাগুলো শুনছিলেন শহিদুল ইসলাম। তিনি জানালেন, এক বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করে ৪০ মণের বেশি ধান কখনো পাননি। কিন্তু এবার পেয়েছেন ৪৫ মণের ওপরে। শহিদুল বলেন, ‘করোনা অন্য পেশার মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হলেও কৃষকের মুখে হাসি এনে দিয়েছে। আমরা ফসল বেঁচে লাভ পাচ্ছি। তাতে করোনার কষ্ট ভুলে গেছি।’

কৃষক শহিদুল আরও বলেন, বছর বছর ধান চাষ করে লোকসান গুনেছেন। ৪০০-৫০০ টাকার বেশি দামে ধান বিক্রি করতে পারেননি। এবার ১ মণ ব্রি–২৮ জাতের চিকন ধান ৮০০ টাকা, আর হাইব্রিড জাতের মোটা ধান ৭৫০ টাকা বিক্রি করছেন। বিগত ১০ বছরের মধ্যে ধানের এই দামই সর্বোচ্চ। প্রতিবছর এমন দাম পেলে কৃষকের লোকসান হতো না।

কিছুটা এগিয়ে যেতে দেখা গেল একদল নারী ভুট্টার খোসা ছাড়াচ্ছেন। কৃষক পরেশ রায় জানালেন, তিন বছর পর এবার ভুট্টা বিক্রি করে কৃষক লাভের মুখ দেখছেন। গত মৌসুমের শুরুতে কৃষক প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রি করেছিলেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচই উঠত না। এবার বিক্রি করছেন কমপক্ষে ৫০০ টাকা মণ।

আরেক কৃষক জানালেন, গত বছর প্রতি মণ গমের বাজারদর ছিল ৭২০ টাকা। এ মৌসুমে কৃষক গম বিক্রি করছেন ১ হাজার টাকা দরে। ধান, ভুট্টা, গমের পাশাপাশি সবজিতেও কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন। বাজারে প্রতি কেজি করলা, শসা, ঢ্যাঁড়স, বেগুনসহ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে।

খেত থেকে সবজি তুলে ট্রাকে সাজাচ্ছেন কৃষকেরা। সদর উপজেলার বরদেশ্বরী এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
খেত থেকে সবজি তুলে ট্রাকে সাজাচ্ছেন কৃষকেরা। সদর উপজেলার বরদেশ্বরী এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ হাট ধান-গম কেনাবেচার জন্য প্রসিদ্ধ। সারা বছর ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁকডাক লেগেই থাকে। ধান ব্যবসায়ী এনামুল হক জানালেন, এ বছর সারা দেশে ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম ও ৮ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান কিনছে সরকার। সরকারের ঘোষণার পরেই বাজারে ধানের দাম বাড়তে শুরু করে।

জেলা বাজার অনুসন্ধানকারী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, করোনার প্রভাবে খাদ্যসংকটের শঙ্কা থেকে সরকার গুদামে প্রতি কেজি গম ২৮ টাকা ও বোরো ধান ২৬ টাকা দরে কিনছে। সরকারের সময়োপযোগী এ পদক্ষেপে কৃষকেরা এই সংকটেও লাভের মুখ দেখছেন। অন্য বছর ধান বাজারে নিয়ে গিয়েও দাম না পেয়ে সড়কে ফসল ছিটিয়ে প্রতিবাদ করতেন কৃষক। কিন্তু এবার তাঁরা বেশ খুশি।

দাম পেয়ে আমনে কৃষকের মন
কয়েক বছর টানা ধান আবাদ করে লোকসানে পড়েছিলেন কৃষকেরা। চলতি বোরো মৌসুমেও করোনায় সেই শঙ্কা পেয়ে বসেছিল কৃষককে। কিন্তু এবার ভালো দাম পেয়ে কৃষকেরা নতুন উদ্যমে আমন চাষে মন দিয়েছেন। বীজতলা তৈরির পর তা পরিচর্যায় লেগে পড়েছেন। অনেকে কৃষক জমিতে চারা রোপণও করে ফেলেছেন। জেলায় এবার ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

সদরের দাসপাড়ার কৃষক অশোক বর্মণ বোরো মৌসুমে সাত বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। বোরোর ভালো দাম পেয়ে এবার তিনি আরও তিন বিঘা জমিতে আমন আবাদের পরিকল্পনা করেছেন। অশোক বলেন, ‘ধানের এমন দাম পাইলে, আমাদের আর কী লাগে!’

থমকে গেছে সবজি রপ্তানি
কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে সবজি পাঠাত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। গত বছর জেলা থেকে ২০০ মেট্রিক টন সবজি রপ্তানি হয়েছিল। সদরের চামেশ্বরী গ্রামের মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী ১৪ বিঘা জমিতে জৈব পদ্ধতিতে করলা, লাউ, শসা ও বেগুনের আবাদ করেছেন। কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ২০১৮ সালে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ পান। মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাজারে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজির চাহিদা একটু বেশি। তাঁর উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি এজেন্সির মাধ্যমে ইংল্যান্ড, দুবাই, বাহরাইন, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, হংকংসহ ১০টি দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার বিদেশে সবজি পাঠানো সম্ভব হয়নি। এতে তাঁরা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ক্ষতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বিদেশে যেসব সবজি পাঠানো হয়, সেগুলো অর্গানিক। কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয় না। অর্গানিক সবজির ফলনও কম হয়। এ কারণে বাজারদরও একটু বেশি। বিদেশে সবজি পাঠাতে না পেরে তা স্থানীয় বাজারে সাধারণ সবজির দরেই বিক্রি করতে হচ্ছে।

সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা
বুধারু রায়ের মতো অনেকেই সরকারি গুদামে বিক্রির অপেক্ষা না করে বাজারে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকের আগ্রহ না থাকায় ধান সংগ্রহ অভিযান শুরুর এক মাস হলেও ঠাকুরগাঁওয়ের খাদ্যগুদামে ধান সংগ্রহ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এবার জেলায় বোরো ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩০৯ মেট্রিক টন। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে। ধানের বাজারদর বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ ক্ষেত্রে একজন কৃষকের জন্য সর্বোচ্চ ৬ টন ধান বিক্রির সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রতি কেজি ধানের মূল্য ধরা হয়েছে ২৬ টাকা। কেনার ক্ষেত্রে খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ ধানের আর্দ্রতা নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া বিজাতীয় পদার্থ পয়েন্ট ৫ শতাংশ, ভিন্ন জাতের মিশ্রণ ৮ শতাংশ, অপুষ্ট ও বিনষ্ট দানা ২ শতাংশ এবং চিটা দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হলেও কৃষকেরা ধান বিক্রি করার সুযোগ পাবেন।

বিদায়ী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাবুল হোসেন বলেন, ‘কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য দিতেই সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য কেনার কর্মসূচি নেওয়া হয়। এখন বাজারে ধানের দাম বাড়তি। এ পর্যায়ে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলো কি না, তা নিয়ে ভাবছি না। কৃষক ধানের দাম পেলেই হলো। সেটা সরকারি গুদামে বা বাজারে যেখানেই বিক্রি করে হোক।’

থমকে গেছে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের মার্চে ঠাকুরগাঁও সফরে এসেছিলেন। বড় মাঠের জনসভায় তিনি ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দেন। এর মধ্যে একটি ছিল কৃষিভিত্তিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ প্রকল্পটির কাজ করোনা পরিস্থিতিতে থমকে গেছে। জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, কৃষিভিত্তিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জায়গা নির্ধারণের কাজটি চললেও এখন তা করোনার কারণে গতি হারিয়ে ফেলেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেটা শুরুর সুযোগ নেই। তবে জেলায় ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কৃষকেরা লাভবান হবেন।

কৃষিযন্ত্র আর মোটরসাইকেল শোরুমে ভিড়
মোটরসাইকেলের শোরুম গুড্ডু মোটরস। সুসজ্জিত শোরুমে নানা মডেলের মোটরসাইকেলের ছবি। কিন্তু ছবি থাকলেও সেখানে নেই কোনো মোটরসাইকেল। করোনাকালে মোটরসাইকেল আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন শোরুমটি ফাঁকা। দুই ব্যক্তি শোরুমে গিয়ে খানিক বাদে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, তিনি কৃষিকাজ করেন। ট্রাক্টর ভাড়া নিয়ে তাঁকে জমি চাষ করতে হয়। এবার ফসলের দাম পেয়ে একটি ট্রাক্টর কেনার কথা ভেবে এখানে এসেছিলেন।

করোনার জন্য সব সরকারি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ। এতে মাইক ও ডেকোরেটর ব্যবসায় ধস নেমেছে। টিকে থাকতে জেলা শহরের লতিফ ডেকোরেটরের স্বত্বাধিকারী আবদুল লতিফ নেমেছেন কাঁচামালের ব্যবসায়। ছবি: প্রথম আলো
করোনার জন্য সব সরকারি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ। এতে মাইক ও ডেকোরেটর ব্যবসায় ধস নেমেছে। টিকে থাকতে জেলা শহরের লতিফ ডেকোরেটরের স্বত্বাধিকারী আবদুল লতিফ নেমেছেন কাঁচামালের ব্যবসায়। ছবি: প্রথম আলো

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে শোরুমের স্বত্বাধিকারী আহসান হাবিব বলেন, মাস তিনেক ধরে কোনো মোটরসাইকেল আসছে না। যা সংগ্রহে ছিল সব বিক্রি হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন ক্রেতা মোটরসাইকেল কিনতে এসে ঘুরে যাচ্ছেন। ক্রেতাদের বেশির ভাগই কৃষক। তাঁর একটি ট্রাক্টরেরও শোরুম রয়েছে, সেখানেও একই অবস্থা।

ডেকোরেটর ছেড়ে সবজি বিক্রেতা
শহরের অস্থায়ী সবজি বাজার। বাজারে রঙিন কাপড়ে ঘেরা একটি দোকান। টেবিলে সাজানো নানা সবজি। দোকানটি আবদুল লতিফের। কদিন আগেও তাঁর জমজমাট ডেকোরেটর ব্যবসা ছিল। করোনার জন্য সব সরকারি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ, এতে মাইক ও ডেকোরেটর ব্যবসায় ধস নেমেছে। টিকে থাকতে আবদুল লতিফ কাঁচামালের ব্যবসায় নেমেছেন। তিনি বলেন, মাস চার ধরে ব্যবসা বন্ধ। বেতন দিতে না পেরে কর্মচারীদের বিদায় করে দিয়েছেন। নিজের সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়ায় কাঁচামালের দোকান নিয়ে বসলেন।

নানা সুখবর ও অনুষ্ঠানের আয়োজন জানাতে শহরে সারা বছর চলত মাইকে প্রচারণা। সেদিন এখন নেই। শহরবাসীর কানে এখন খুব কমই মাইকের শব্দ ভেসে আসে। শহরের সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, সাউন্ড সিস্টেমের অধিকাংশ দোকান খোলা থাকলেও নেই ব্যস্ততা। সকালে বাসা থেকে এসে দোকান খুলে বসে থেকে আবার সন্ধ্যায় ফিরে যান ব্যবসায়ীরা। দিন শেষে হিসাবের খাতা শূন্য। শহরের একতা মাইকের স্বত্বাধিকারী আবুল হোসেন বলেন, শহরে ১০ জনের বেশি মাইক ব্যবসায়ী রয়েছেন। বিভিন্ন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন মাসে তাঁদের তিন শ টাকাও আয় হয়নি। তবে কর্মচারীদের খরচ দিতে হচ্ছে। জমানো টাকা যা ছিল, তা–ও শেষ হয়ে গেছে।

ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ১১ এপ্রিল। ২৫ জুলাই পর্যন্ত করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩০৬ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২২১, আর মারা গেছেন ৫ জন।