গাইবান্ধায় অপ্রতুল ত্রাণ, দিশেহারা বানভাসিরা

গাইবান্ধার পাঁচটি উপজেলার ২৯টি ইউনিয়ন দীর্ঘদিন প্লাবিত হয়ে রয়েছে। পানিবন্দী রয়েছে এসব এলাকার প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় চরম দুর্ভোগে রয়েছেন তাঁরা। প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাচ্ছেন না তাঁরা। বিশেষত দুর্গম চরাঞ্চালগুলোয় ত্রাণ যাচ্ছে না। এ কারণে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাঁদের। নদ-নদীর পানি অত্যন্ত ধীরে কমায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই।

বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের কালাসোনা গ্রামের দিনমজুর কাশেম মিয়া বলেন, ‘বান আসি হামরা হাবুডুবু খাবার নাগচি। আগের বানের পানিত হামারঘরে ঘরের বেড়া নসটো হচে। সেগলা ভালো করি নাই। তার মদ্দে আবার পানি আচ্চে। উঁচা জাগাত যাই নাই। ১২ দিন থাকি কষ্ট করি পানির মদ্দে আচি। বানের মদ্দে কোনো ইলিপ (ত্রাণ) পানো না।’ একই গ্রামের দিনমজুর আবুল হোসেন বলেন, ১২ দিন ধরে পানিতে ভাসছেন। কিন্তু ত্রাণ পাননি। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি ত্রাণ দেননি।

পাশের কাবিলপুর গ্রামের করিমন নেছা বলেন, ‘হামার ঘরে এ্যাকনা ঘর, তাক ১১ দিন আগোত ডুবি গেচে। তকন থাকি বানদোত আচি। মানষের বাড়িত কাম করি সোংসার চলাছি। একন বানের সমায় কাউয়ো কামোত নেয় না। এবাড়িত-ওবাড়িত থাকি চায়া খাব্যার নাগচি। কয় দিন চেরমেনের কাচে গেচিনো, ইলিপ পাই নাই।’

উড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৪০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি, যা প্রতিজনকে ১০ কেজি করে ৪ হাজার জনের মধ্যে বিতরণ করেছি। হাতে কোনো ত্রাণ নেই। তাই দিতে পারছি না। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে ত্রাণ চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ অভাবী। কিন্তু সে অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ পাইনি।’

ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু রায়হান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় যেসব ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলোয় বেশি ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।

ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ভাষারপাড়া গ্রামের রিকশাচালক মফিজল মিয়া (৪৫) বলেন, ‘হামারঘরে বাড়ির কাচে বোরমোপুত্র (ব্রহ্মপুত্র) নদী। নদীত পানি বাড়লে হামারঘরে ঘরবাড়ি ডুবি যায়। উঁচা জাগাত যাই নাই। ১৩ দিন থাকি কসটো করি পানির মদ্দে আচি। বানের মদ্দে কোনো ইলিপ পানো না।’ একই গ্রামের দিনমজুর আবুল কালাম (৫০) বলেন, বন্যার সময় হাতে কাজ নেই। ১৫ দিন ধরে পানিতে ভাসছেন তাঁরা। কিন্তু ত্রাণ পাননি।

কঞ্চিপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান লিটন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়নটিতে মোট লোকসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষ অভাবী। নদীভাঙনের কারণে এ ইউনিয়নে অভাবী লোকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ পাননি। এ পর্যন্ত ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন, যা ১০ কেজি করে ৮০০ জনের মধ্যে বিতরণ করেছেন। হাতে কোনো ত্রাণ নেই। তাই দিতে পারছনে না।

গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিশ আলী প্রথম আলোকে বলেন, বন্যাকবলিত জেলার চার উপজেলার জন্য ৩২০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ লাখ টাকা, চার লাখ টাকার শিশুখাদ্য, দুই লাখ টাকার গোখাদ্য ও তিন হাজার ৬০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে, যা বিতরণ চলছে।

নদীর পানি সামান্য কমেছে
আজ রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়েনি। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়িঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আজ দুপুর ১২ টায়ও একই ছিল। ঘাঘট নদের পানি মাত্র ১ সেন্টিমিটার কমেছে। দুপুর ১২টায় ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

২৪ ঘণ্টায় করতোয়ার পানি ৯ সেন্টিমিটার কমেছে। আজ দুপুর ১২টায় করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুপুর ১২টায় তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি ১ সেন্টিমিটার কমেছে।

আজ দুপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় সামান্য করে পানি কমেছে। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি পদ্মা ও মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু পদ্মা ও মেঘনায় পানি বেশি। এ কারণে পানি খুব ধীরগতিতে নামছে।