সরকারি ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ, পাটের দামে হতাশ কৃষক

পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়ানোর পর বাড়ি নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। শনিবার পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ছেঁচানিয়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো।
পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়ানোর পর বাড়ি নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। শনিবার পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ছেঁচানিয়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো।

পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় এবার পাটের আবাদ বেড়েছে। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকের মজুরিসহ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা পাট বিক্রি করে লাভ পাচ্ছেন না। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় স্থানীয় বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই এবার পাট কিনছেন না। ফলে বাজারে পাটের দাম কমে গেছে।

কয়েকজন পাটচাষি বলেন, বাজারে নতুন পাট উঠতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় চাষিরা পাটের দাম নিয়ে রীতিমতো শঙ্কায় রয়েছেন। এরপরও বেসরকারি পাটকলগুলো চালু থাকায় বাজারে প্রতি মণ পাট ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দামে কৃষকের অখুশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু উৎপাদন খরচ বড়ে যাওয়ায় এই দামে পাট বিক্রি করে কৃষকের শুধু খরচই কোনোমতে উঠছে। তাই কৃষকেরা প্রতি মণ পাটের দাম আড়াই হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছেন।

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, এবার সাঁথিয়ায় ৮ হাজার ৬৬৫ হেক্টর ও বেড়ায় ২ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে। গতবার সাঁথিয়ায় ৬ হাজার ৫০০ ও বেড়ায় ২ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছিল। গতবারের চেয়ে দাম ভালো হবে, এই আশায় কৃষকেরা এবার বেশি জমিতে পাটের আবাদ করেন।

পাটচাষিরা বলেন, এবার পাটের ফলন ও মান বেশ ভালো হয়েছে। প্রতি বিঘায় প্রায় ১০ মণ ফলন পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরগুলোর তুলনায় এবার দামও কিছুটা ভালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষকেরা পাটে লাভের দেখা পাচ্ছেন না। লাভ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন কৃষক বলেন, পাটবীজ, কীটনাশক সবকিছুরই দাম বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এবার শ্রমিকের মজুরি ব্যাপক বেড়ে গেছে। ফলে পাট চাষে খরচ বেশি বেড়েছে।

কয়েকজন পাটচাষি বলেন, পাট চাষের শুরু থেকে রোদে শুকানো পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আগে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া গেলেও এবার তা বেড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা হয়েছে। আবাদের শুরু থেকে পাট বড় হওয়া পর্যন্ত প্রতি বিঘায় শ্রমিক ও আবাদ খরচ মিলিয়ে সাড়ে চার হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। পাট জাগ (পচানো) দেওয়ার জন্য পাট কেটে দূরদূরান্তে ভ্যানে অথবা নছিমন-করিমনে করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এভাবে প্রতি বিঘা জমির পাট নিয়ে যেতেই ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যাচ্ছে। এরপর পাট কাটা, জাগ দেওয়া, ছাড়ানো ও শুকানো বাবদ লাগছে বিঘায় ২০ থেকে ২২ জন শ্রমিক। এভাবে প্রতি বিঘায় সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি মণে চাষিদের উৎপাদন খরচ দুই হাজার টাকার ওপরে গিয়ে ঠেকছে।

গতকাল বেড়া ও সাঁথিয়ার পাটের বাজারে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি হতে দেখা গেছে। এই দামে পাট বিক্রি করে হাটে যাওয়া-আসার পরিবহন খরচ মিলিয়ে চাষিদের উৎপাদন খরচ কোনোরকমে উঠছে। এর মধ্যে আবার যেসব পাটচাষি অন্যের জমি বর্গা নিয়েছিলেন, তাঁদের উল্টো লোকসান দিতে হচ্ছে।

সাঁথিয়ার ছেঁচানিয়া পূর্বপাড়া গ্রামের পাটচাষি দুলাল মিয়া বলেন, ‘কামলার (শ্রমিক) সঙ্গে পরিবারের লোকজন মিল্যা আমরাও হাড়ভাঙা খাটুনি দিছি। কিন্তু সেই খাটুনির কোনো দাম পাওয়া গেল না। প্রতি মণ পাটের দাম আড়াই হাজার টাকা পাওয়া গেলি কৃষকেরা কিছুটা হলেও লাভের মুখ দেখত।’

পাবনার বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামে পাট শুকাচ্ছেন এক কৃষক। শনিবার তোলা ছবি। প্রথম আলো
পাবনার বেড়া উপজেলার বড়শিলা গ্রামে পাট শুকাচ্ছেন এক কৃষক। শনিবার তোলা ছবি। প্রথম আলো

বেড়ার বড়শিলা গ্রামের বর্গাচাষি সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যের সোয়া বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করিছি। এবার কামলার সাথে নিজেও হাড়ভাঙা খাটুনি দিছি। কিন্তু যে অবস্থা দেখতেছি, তাতে লাভ তো দূরের কথা, ঘরের টাকা গচ্চা দেওয়া লাগবি।’

কয়েকজন কৃষক ও পাট ব্যবসায়ী বলেন, সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করায় এগুলোর ক্রয়কেন্দ্রগুলোও বন্ধ রয়েছে। ফলে স্থানীয় পাট ব্যবসায়ীরা পাট কিনছেন না। বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য দূরের পাট ব্যবসায়ীরা হাটে এসে পাট কিনছেন। পাটকলের সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলো চালু থাকলে পাটের চাহিদা ও দাম আরও বাড়ত।

বেড়া বাজারের পাট ব্যবসায়ী শামসুল হক বলেন, ‘আমার নিজেরসহ বেড়া উপজেলার পাট ব্যবসায়ীদের ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা সরকারি পাটকলগুলোর কাছে বকেয়া পড়ে আছে। এ অবস্থায় আর্থিক দুরবস্থার কারণে আমরা এবার কেউই পাট কিনছি না। সরকারি পাটকল চালু থাকলে পাটের দাম আরও উঠত।’