অগ্নিদগ্ধ মিশুর মৃত্যু ঘিরে রহস্য

প্রর্তীকী ছবি
প্রর্তীকী ছবি

মেয়েটির নাম মিশু আক্তার। বয়স ২০ বছর। কাজ দেওয়ার কথা বলে মেয়েটিকে ১ জুলাই কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকার বংশাল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকা আসার ১১ দিন পর ১২ জুলাই মেয়েটির শরীরে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয় বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। মেয়েটির মা কল্পনা আক্তার বংশাল থানায় দুজনের নামে হত্যা মামলা করেন।

বংশাল থানার পুলিশ এজাহারে নাম থাকা দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন মোখলেছ (৩০) ও নাসির উদ্দিন (২৫)। তাঁদের মধ্যে নাসির ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে গতকাল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কারাগারে আছেন আসামি মোখলেছ।

বংশাল থানার পুলিশ দাবি করছে, মিশু আক্তারকে কেউ খুন করেনি। নিজেই তিনি তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। নাসিরের সঙ্গে মিশুর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। নাসির বিয়ে না করায় মিশু নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ জুলাই মারা যান।


পুলিশ বলছে, প্রকাশ্যে সড়কে মেয়েটি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। কিন্তু এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা ঘটনাস্থলে কেউ ছবি তুলেছেন—এমন কারও সন্ধান এখন পর্যন্ত পায়নি তারা। এমনকি ঘটনার পর মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হলেও থানা-পুলিশ বলছে, ঘটনার ৬ দিন পর বিষয়টি জানতে পেরেছে।

২০ বছর আগে মিশুর বাবা তাজুল ইসলাম মারা যান। মায়ের কাছে মিশু বড় হয়ে ওঠেন। কিশোরী অবস্থায় মিশুর বিয়ে হয়। তাঁর একটি মেয়ে (৭) ও একটি ছেলে (৫) আছে। গত জানুয়ারি মাসে তাঁর স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়। এরপর মায়ের কাছেই ছিলেন মিশু।

মিশুর মা কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দুই মেয়ে, এক ছেলে। মিশু সবার ছোট। জানুয়ারি মাসে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় মিশু তাঁর কাছেই ছিল। মিশুর সন্তানেরা থাকে দাদা-দাদির কাছে। করোনায় এলাকায় কাজ না থাকায় তাঁর মেয়ে ঢাকায় কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁদের এলাকার মোখলেছ মিশুকে ঢাকায় কাজ দেওয়ার কথা বলে ১ জুলাই নিয়ে আসেন। পরে ১৫ জুলাই মোখলেছের শ্যালক নাসির ফোন করে জানান, মিশু নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। খবর পেয়ে পরদিন তিনি ঢাকায় আসেন। জানতে পারেন, তাঁর মেয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। পরে তিনি বাদী হয়ে মোখলেছ ও তাঁর শ্যালক নাসিরের নামে বংশাল থানায় হত্যা মামলা করেন।

কীভাবে মিশু মারা গেছেন, সে ব্যাপারে তাঁর মাকে কিছুই জানায়নি বংশাল থানার পুলিশ।

অবশ্য মিশুর মায়ের করা হত্যা মামলায় মোখলেছ ও তাঁর শ্যালক নাসির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে গতকাল ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে।


বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা যেসব তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, মিশু খুন হননি। মিশু নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’


মামলায় মিশুর মা ঘটনাস্থল হিসেবে আসামি মোখলেছের বংশালের বাসার ঠিকানা দেখালেও পুলিশ বলছে, মিশু আসামি মোখলেছের বাসায় গায়ে আগুন ধরিয়ে দেননি। পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ১২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে সবার সামনে মিশু গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বংশাল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আহম্মদ আলী মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, মিশুর গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে ১২ জুলাই। মিশুর মা হত্যা মামলা দায়ের করলে আসামি নাসির উদ্দিন ও মোখলেছকে হবিগঞ্জ থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়। মিশুর মা বলছেন, ঘটনা ঘটছে মোখলেছের বাসায়। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটেছে সিদ্দিকবাজার হাবিব মার্কেটের সামনে। করোনার আগে থেকে নাসিরের সঙ্গে মিশুর সম্পর্ক হয়। মিশু নাসিরকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু বিয়ে না করায় মিশু সেদিন নাসিরের সামনে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুন ধরিয়ে দেন। তখন নাসিরসহ স্থানীয় লোকজন মিশুর গায়ের আগুন নিভিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিশু মারা গেছেন।


মিশুর মা কল্পনা আক্তার বলেন, মোখলেছ মিশুকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। নাসিরের সঙ্গে মিশুর সম্পর্ক ছিল কি না, তা জানেন না। মিশুকে কাজ দেওয়ার কথা বলে ঢাকায় এনে তাঁর মেয়েকে মোখলেছসহ অন্যরা মিলে গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা করেছেন।

কল্পনা আক্তার জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন।


কল্পনা আক্তার আরও বলেন, ‘মিশু ঢাকায় আসার এক দিন পর আমি মিশুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছি। মিশু তখন আমায় বলেছিল, “আম্মা আমি ভালো আছি।” আমার মিশু কী কারণে খুন হলো, আমি জানতে চাই। আমি সঠিক বিচার চাই।’

তদন্ত কর্মকর্তা আহম্মদ আলী মোল্লা জানান, মিশুর মৃত্যুর রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য তাঁর ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষার করা হচ্ছে।