ভয়াবহ কিছু সময়

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন এই লেখক, কবি। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।

২৩ তারিখ বিকেল থেকে আমাদের বাসার সবচেয়ে ছোট সদস্য চার বছর বয়সের বেবির জ্বর শুরু হয়। ১০১–এর মধ্যেই তাপমাত্রা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর শরীরে র‍্যাশ উঠে গেল প্রচুর। সঙ্গে বেবির আমাশয় শুরু হলো। এদিকে আমাদের প্রত্যেকের কাশি বেড়ে গেল আগের তুলনায়। আমরা হাসপাতালে বেবির চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। তিনি সব শুনে বললেন, বেবিরও করোনা পজিটিভ হয়ে গেছে। তবে তিনি এটাও বললেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। বেবির পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও চিকিৎসার পাশাপাশি আপনাদেরও চিকিৎসা হবে।

সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যোগাযোগ করার পরে আমরা কোনো কেবিন পেলাম না, জেনারেল বেড। কীভাবে কী করব?

একজনের কাশি শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল। বাসায় মেডিসিনের সঙ্গে ইনহেলার, নেবুলাইজার মেশিন, এগুলোর ব্যবস্থা করেছি আমরা। তাই আল্লাহকে ডেকে ও সাহস করে বাসায় থাকলাম।

আমি এবং সর্বপ্রথম যার জ্বর হয়েছিল, এই দুজন আমরা হাসপাতালে গিয়ে ব্লাড ইউরিন টেস্টসহ ফুসফুসের সিটি স্ক্যান করালাম।

এদিকে আমাদের বেবিটা আল্লাহর রহমতে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থেকে দুদিন পার করল হাসপাতালে না গিয়ে। বাচ্চাদের বিষয়ে চিকিৎসকেরা বললেন, বাচ্চাদের বডি রেসপন্স করে সুস্থ হয়ে যায়। আল্লাহর রহমতে বাচ্চাদের নিয়ে তেমন ভয় নেই।

আত্মীয়, বন্ধু, মসজিদ, মাদ্রাসায়, এতিমখানায় ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আমাদের জন্য বিশেষ দোয়া হচ্ছিল, সাদকা দেওয়া, ডাক্তার, মেডিসিন, টোটকা ও সাহসে চলছিলাম আল্লাহর ওপর ভরসা করে।

পঁচিশ তারিখের রিপোর্টে একজনের ব্লাডে অ্যালার্জির পরিমাণ অনেক বেশি পাওয়া গেল। যেটা ১৩৫ থাকার কথা, সেটা ৭০০–এর ঘরে।

ডাক্তাররা বললেন, করোনা এক–একজনের শরীরে একেকভাবে ও একেক অর্গানকে ড্যামেজ করে। করোনা এই অ্যালার্জি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণেই ওর কাশি ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

এদিকে আমার ফুসফুসে পাওয়া গেল কোভিড–১৯। এই ফুসফুসে ইনফেকশন নিয়ে আমার চেয়েও বাসার সবার মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। তাদের কান্নাকাটি ও অস্থিরতা দেখে আমি বুঝে গেলাম কিছু একটা খারাপ রিপোর্ট আমার। আমি নিজেই প্রতিবারের মতো শক্ত ভূমিকা নিলাম। তা হলো হাসপাতালে যাব না ইনশা আল্লাহ।

তবে আমার স্বামী যেখানেই যারা যারা পরিচিত ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, সবার একই পরামর্শ, দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করুন।

আমার বড় ভাইকে ফুসফুসের এই রিপোর্টের কথা জানানো হলো না। কারণ, তাঁর হার্টে চারটা রিং পরানো। আর তার পরানের অংশ আমি। মাত্র চার মাস আগে আমরা প্রায় একই সঙ্গে বাবা-মাকে হারিয়েছি। বড় ভাই এখন আমার রিপোর্ট জানলে তার শরীর খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেত।

সবার চাপাচাপি–কান্নাকাটিতে আমি রাজি হলাম। যদি আমার খুব বেশি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তাহলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেও। কিন্তু এখন না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল এবার আমি হাসপাতালে গেলে আর ফিরে আসতে পারব না। আর শেষ সময়টা আমি আমার প্রিয়জনদের মুখ দেখতেই পারব না।

আমার ছেলেটা এমনিতেই পরবাসে (কানাডায়)। তাঁকেও টোটালি করোনা বা অসুস্থতার কথা জানাইনি। খুব বেশি ছেলেটার কথা মনে পড়ছিল। খুব কান্নাও পাচ্ছিল ওর কথা মনে করে। মা চলে গেলে ও দেখতেও পারবে না। আমিও ওকে দেখতেই পারব না।

তবু বুকে খুব সাহস বাঁধলাম। ওদের বললাম, আল্লাহ ভরসা। কত মানুষ সুস্থ হচ্ছে। ইনশা আল্লাহ হায়াত থাকলে আমি সুস্থ হব। না থাকলে চলে যাব। যখন যাব, তখন দেখা যাবে। ওপরে আল্লাহ আছেন। আর তোমরা সবাই আমার সাহস। আমি একটা রাত অন্তত দেখব। কারণ আজ রাতে হাসপাতালে গেলে আমার বড় ভাইকে কিছুতেই ভুল বোঝানো যাবে না। সে বুঝে যাবে আমার খারাপ কিছু রিপোর্ট। প্লিজ তোমরা সবাই শান্ত হও। আমাকে সাহস দাও। আসো, আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি আর চেষ্টা করি।

আলহামদুলিল্লাহ, সেভাবেই বাসায় চিকিৎসা শুরু হলো। আমি আরও দুজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। মোট তিনজন ডাক্তারের পরামর্শমতো মেডিসিন ও অন্য সব নিয়ম মেনে এই কঠিন জার্নি শুরু করলাম।

বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার মেশিন, ইনহেলার, পালস অক্সিমিটার, প্রেশার মাপার যন্ত্র এনে নিলাম পরের দিন।

ডাক্তাররা বলে দিল যে,অক্সিজেন লেবেল নব্বইয়ের নিচে নেমে গেলে ও প্রেশার বেশি নেমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে। সেভাবে আমি এক নিকট আত্মীয়ের হাসপাতালে সব ব্যবস্থাও করে রাখলাম। যদিও জেনারেল ফিজিশিয়ান ছাড়া এক্সপার্ট ডাক্তাররা বেশির ভাগ হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে এখন নাকি করোনাকালীন আসেনও না।

তাই বাসার মধ্যে পরবর্তী ১৫টা দিনের করোনা জার্নির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শুরু হলো আমার।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন। আমাদের করোনা পজিটিভ আসার দশ দিন পরে সরকারের পক্ষ থেকে ফোন নম্বরে কল দিয়ে আমাদের খবর জানতে চাইল। আমরা কেমন আছি। খাবার কে সরবরাহ করে? যথেষ্ট কোয়ারেন্টিন পালন করছি কি না? খাবার খেতে পারি কি না? ঘুম হয় কি না? কোনো সহযোগিতা লাগলে তাদের জানাতে। তারা টিম পাঠাবে আর এক সপ্তাহ পরে আবার খবর নেবে। ভাবলাম দশ দিন পরে সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়ার মানে কী? বেঁচে থাকা? নাকি মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া। অবশ্য পরবর্তী এক সপ্তাহ পরে আর কল করেন নাই। এই হলো দেশের অবস্থা!

এদিকে খুব বেশি দুর্বলতা আমার শরীরে। মাঝেমধ্যে মনে হতো শরীর ছেড়ে দিয়েছে। এই বুঝি নিস্তেজ হয় যাচ্ছি।

এর প্রেশার হাই তো এর লো। এর কাশি ভয়াবহ, ওর শ্বাসকষ্ট। আমার ফুসফুস ইনফেকশনের রিপোর্ট পাওয়ার চার দিন পরে ভয়াবহ গলাব্যথা শুরু হলো আবারও। আরও একটা অ্যান্টিবায়োটিক বাড়িয়ে দিল। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক দুটি খাওয়ার পর আমার গলায় ও মুখের স্কিনে প্রচুর র‍্যাশ উঠে গেল। ডাক্তারকে জানানোর পরে আবার ওই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক চেঞ্জ করে অন্য গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক দিল।

আমার আবারও রোজ একটু পরপর অল্প তাপমাত্রার জ্বর আসছিল। মাঝেমধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে। বুকে খুব ব্যথা হতো। মনে হতো একটা অনেক বড় পাথর চেপে আছে বুকের মধ্যে। কত কত রকমের কষ্ট। এর মধ্যে হঠাৎ আমার কম কম থাকা প্রেশার অনেক বেড়ে গেল। নিচে ১১০, ওপরেরটা ১৬০। কখন কী হয়, এ রকম একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন চলতে লাগল আমার।


আরও পড়ুন:

করোনা জয়ের গল্প: ২
করোনা পজিটিভ এল আমার

*আগামীকাল পড়ুন, পর্ব-৪: আমার স্বামীর মহানুভবতা আমার ঋণ