দেশে করোনায় মৃত্যুহার বাড়ছে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

দেশে করোনায় মৃত্যু কমছে না। গত তিন সপ্তাহে মৃত্যুহারও কিছুটা বেড়েছে। দেশে সংক্রমণ শনাক্তের ১৪৩ দিনে এসে গতকাল মঙ্গলবার করোনায় মৃত্যু ৩ হাজারে পৌঁছেছে।

দেশে করোনায় মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৩ দিনে ১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এটাই সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে করোনায় ১ হাজার মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড। প্রথম ১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ৯৫ দিনে। আর দ্বিতীয় ১ হাজার মৃত্যু পূর্ণ হতে সময় লেগেছিল ২৫ দিন।

চলতি মাসের শুরু থেকে করোনার নমুনা পরীক্ষা কমার সঙ্গে সঙ্গে নতুন রোগী কমছে। কিন্তু রোগী শনাক্তের হার এবং মৃত্যু কমছে না; বরং খুব ধীরে হলেও মৃত্যুর হার বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ৫ জুলাই দেশে করোনায় মোট মৃত্যু ২ হাজার ছাড়িয়েছিল। সেদিন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ছিল ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর গতকাল সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। অবশ্য আক্রান্তের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার এখনো কম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মোট মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এখন ২৮ নম্বরে। তবে দৈনিক মৃত্যুর গড় হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ভালো নয়। করোনার পরিস্থিতি সামগ্রিক তথ্য বিশ্লেষণ করে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা ওয়েবসাইট।

তাদের হিসাবে, গত তিন দিনের গড় মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৮তম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান তৃতীয়। আর পাকিস্তানের অবস্থান ২৩তম। পাকিস্তানে বেশ কিছু দিন ধরে দৈনিক মৃত্যু কমতির দিকে।

অবশ্য সরকারিভাবে নিশ্চিত করা ৩ হাজার মৃত্যুর তথ্যের বাইরে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনায় উপসর্গ নিয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের হিসাবে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনার উপসর্গ নিয়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি করোনায় মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মৃত্যুর ঘটনাগুলো সেভাবে বিশ্লেষণও করা হচ্ছে না।

করোনা সংক্রমণে যাঁদের উপসর্গ জটিল এবং গুরুতর, তাঁদেরই মূলত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত আক্রান্তদের সিংহভাগের উপসর্গ মৃদু। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের বাইরে বাড়িতে এবং হাসপাতালে আনার পথে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন মারা গেছেন নিজ নিজ বাড়িতে। আর ১ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।

প্রতিদিনের মৃত্যুর ২০ শতাংশের মতো হচ্ছে বাড়িতে এবং হাসপাতালে আনার পথে। এই চিত্র বলছে, পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করার পরও অনেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। অন্যদিকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর শয্যার অর্ধেকের বেশি খালি পড়ে আছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উদ্যোগী হলে হয়তো মৃত্যু আরও কমানো যেত। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী সংযুক্ত থাকতে হবে। তাঁরা নিয়মিত রোগীর ফলোআপ করবেন। এপ্রিল পর্যন্ত এটা ছিল। এতে রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে কি না, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার কি না, সময়মতো সে পরামর্শ পাওয়া যেত। তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন হাসপাতালের শয্যার তথ্য দেওয়া হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ।

১২-১৮ জুলাই সংক্রমণের ১৯তম সপ্তাহে মৃত্যুর সংখ্যা তার আগের সপ্তাহের চেয়ে কিছুটা কমেছিল। কিন্তু পরের সপ্তাহ বা সংক্রমণের ২০তম সপ্তাহে সেটা আবার বেড়ে যায়। ওই সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি সপ্তাহের প্রথম তিন দিনেও দৈনিক মৃত্যুর গড় ৪২।

বিশ্বে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে চীনের উহানে। ফেব্রুয়ারির শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীন একটি যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ৬০ বছরের বেশি বয়সী এবং যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ আছে, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। চীনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বয়স ছিল ৬০-এর ওপরে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে মারা যাওয়া ৩ হাজার মানুষের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৮০ শতাংশের বয়স ষাটের ওপরে। অর্থাৎ মারা যাওয়াদের অর্ধেকের বেশি (৫৪ শতাংশ) ৬০ বছরের কম বয়সী।

গতকাল নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২ হাজার ৯৬০ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২ লাখ ২৯ হাজার ১৮৫। এর মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার ৪১৪ জন সুস্থ হয়েছেন।

অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, করোনার ঝুঁকি এড়াতে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যাঁদের লক্ষণ উপসর্গ আছে, তাঁদের নমুনা পরীক্ষা করিয়ে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে হবে।