ভয় আর মামলাতে আটকে গেছে শিক্ষার্থীদের জীবন

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট বাহিনীর হামলা। ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট।  ফাইল ছবি
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট বাহিনীর হামলা। ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট। ফাইল ছবি

দুই বছর আগে নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনে অন্যদের সঙ্গে অংশ নেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তারিক আজিজ। 

আন্দোলন শেষ হওয়ার এক মাস পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে টঙ্গীর বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর জানতে পারেন, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তাঁর নামে নয়টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ১০ মাস পর জেল থেকে জামিনে ছাড়া পান তিনি।

জেল থেকে আপাতত মুক্তি পেলেও ভোগান্তির শেষ হয়নি তারিকের। মামলার কারণে প্রতি মাসে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাঁকে। গত সোমবার মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো মাসের নয় দিনই চলে গেছে হাজিরা দেওয়ার জন্য আদালতে যাওয়া–আসা করতে করতে। জেলে থাকার কারণে দুটো সেমিস্টারের ফল খুব খারাপ হয়েছে। মনে হচ্ছে, ভয় আর মামলাতেই আটকে গেছে জীবন।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম (রাজীব) ও দিয়া খানম (মীম) নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন স্কুল–কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১০ দিন ধরে চলা ওই আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীসহ কয়েক শ ব্যক্তির নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৬০টি মামলা হয়। এসব মামলার বেশির ভাগ আসামিই অজ্ঞাতনামা।

তখন এসব মামলায় গ্রেপ্তার করে ৯৯ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। এঁদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী এখন জামিনে থাকলেও আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাঁদের। তবে গত মার্চ মাস থেকে করোনার কারণে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আপাতত তাঁদের হাজিরা দিতে হচ্ছে না।

আন্দোলনের মাঝপথে ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর জিগাতলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের নির্মম হামলার শিকার হন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডির দিকে যেতে চাইলে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় হামলার শিকার হন। সেদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয় ১২ জন সাংবাদিককেও। হামলাকারীদের অনেকের মুখ হেলমেটে ঢাকা থাকায় তারা হেলমেট বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। দুই বছর হয়ে গেলেও হামলাকারীদের কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মামলা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ওই সময়ে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সরকার বিষয়টি ‘ভুলে’ যায়।

পুরো ঘটনার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সবাইকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার তো মানে হয় না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়টি যাতে দ্রুত সুরাহা হয়, সেই তাগাদা দিয়ে তিনি শিগগিরই জননিরাপত্তাসচিবকে চিঠি দেবেন।

জেল খেটে বেরিয়ে আসা নয়জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে গত সপ্তাহে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, অধিকাংশ মামলার বাদী পুলিশ। যে কারণে এসব মামলার প্রভাব ব্যক্তিজীবনে বহুমুখী। কেউ কেউ শিক্ষাজীবন শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। কোনোভাবে শিক্ষাজীবন শেষ হলেও মামলার কারণে সরকারি চাকরি না পাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মামলার তথ্য থাকায় পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়ার কথাও বলেছেন কয়েকজন। আবার তাঁদের অনেকের জন্য মামলার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা বলছেন, যৌক্তিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরও এসব মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়েছে। মামলাগুলো থেকে তাঁরা অব্যাহতি চান।

শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা এসব মামলার বিষয়ে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাগুলো পেন্ডিং অবস্থায় আছে।’ নিষ্পত্তি বা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার একক সিদ্ধান্তে তো নিষ্পত্তি হবে না বুঝতেই পারছেন। সিদ্ধান্ত আরও ওপর থেকে আসতে হবে। এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

পুলিশের করা বিভিন্ন মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তখন দুই কারণে মামলা হয়। প্রথমত রাজপথে আন্দোলন করার কারণে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রসহ শত শত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রচার চালানো। এ ছাড়া গুজব ছাড়ানো হয়েছে এমন অভিযোগও করে পুলিশ।

এমনই একটি মামলায় কারাভোগ করে বেরিয়ে আসা সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা চলতে থাকায় আর্থিক ও মানসিক সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। এখন পুলিশ দেখলেই ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি গ্রেপ্তার করতে এল। এ ছাড়া পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। চাকরির বাজারে কেউ মামলার আসামিকে নেবে কি না, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে। সব মিলিয়ে যেদিকেই তাকাই, সেদিকেই মামলাটাকে একটা বাধা মনে হচ্ছে।’

আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলার অন্যতম কারণ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়া ও ভিডিও শেয়ার করা। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ আনা হয় ফেসবুক, টুইটার, ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ, ইউটিউব, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগে বিভিন্ন উসকানিমূলক লেখা, পোস্ট, ফটো বা ভিডিওর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর। অভিযোগ ছিল গুজব ছড়ানোরও।

তবে দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখনো গুজবের উৎসের সন্ধান পায়নি পুলিশ। ডিএমপির সাইবার অপরাধ দমন বিভাগের উপকমিশনার এ এফ এম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, যারা গুজব ছড়িয়েছিল, তাদের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। মামলাগুলো এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।

ওই সময় শুধু জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়েই নয়, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয় মিরপুরেও। এ ছাড়া ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ অবস্থাতেই হামলার শিকার হন। এসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা জড়িত। এ ছাড়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন শিক্ষার্থীরা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোকে আইনের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দু–একজনের বিরুদ্ধে যদি অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাঁদের মামলাগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত। অন্য মামলাগুলো দীর্ঘায়িত না করে তুলে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোনো ভিত্তি বা স্বল্প ভিত্তি না থাকলেও ফৌজদারি আইনের অপব্যবহার করে প্রতিবাদ মিছিল, আন্দোলন ও বিরুদ্ধ মতকে দমন করা হচ্ছে।