একটি অনুমোদনহীন হাসপাতাল

সিটি হাসপাতাল ভবন।
সিটি হাসপাতাল ভবন।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি চলছে অবৈধভাবে। গাজীপুরে অবস্থিত ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালের কোনো অনুমোদনই নেই। প্রতিষ্ঠার প্রায় ছয় বছরেও সেখানে চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ তৈরি করা হয়নি। গতকাল বুধবার ও আগের দিন সরেজমিন খোঁজ নিয়ে সেখানে একজন রোগীও ভর্তি পাওয়া যায়নি। আর সিটি মেডিকেল কলেজটি বেশির ভাগ শর্ত পূরণ না করেও বিশেষ বিবেচনায় ছাত্রভর্তির অনুমতি পেয়েই চলেছে।

এই অবস্থার মধ্যেও কোভিড চিকিৎসার নামে ১০০ শয্যার ইউনিট খুলেছিল হাসপাতালটি। কিন্তু রিজেন্ট, জেকেজির পরিণতি দেখে দ্রুত এই ইউনিট গুটিয়ে ফেলা হয়। হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত সোমবার কোভিড চিকিৎসার ব্যানারটি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।

ওই কর্মকর্তারা জানান, গত জুনের মাঝামাঝি কোভিড চিকিৎসার ঘোষণা দেওয়া হয়। এক বিদেশি নাগরিক সেখানে কোভিড চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন জানিয়ে তাঁকে ফুল দিয়ে বিদায় জানানোর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়। এটি প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কোভিড রোগী ভর্তি করে টাকা কামানো। কিন্তু রিজেন্ট, জেকেজির প্রতারণা ধরা পড়ার পর সিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর ঝুঁকি নিতে চায়নি।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, মহীউদ্দীন খান মেডিকেল কলেজটি অবকাঠামোসহ কিনে নেন। কিন্তু বিক্রেতাকে পাওনা সব টাকা বুঝিয়ে দেননি। তাই বিক্রেতা কাগজে–কলমে মালিকানা হস্তান্তর করেননি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুরো প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে আছে অনিয়মের ওপর। প্রতিষ্ঠানটি ক্রয়, পরিচালনা, চিকিৎসাসেবা, ব্যাংক হিসাব খোলা, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ, হিসাব ও নিরীক্ষা—সব ক্ষেত্রেই অনিয়মের পাহাড় তৈরি হয়েছে।

সাবেক প্রভাবশালী এই আমলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে–পরে ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে তোলেন। সবটাই নানা রকম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ওই ব্যাংক থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ঋণের কিছু টাকা তাঁর (মহীউদ্দীন খান) ব্যাংক হিসাবে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতিসহ কয়েকজনের নাম আসে। পরে তাঁদের সরিয়ে দিয়ে ব্যাংকটি পদ্মা ব্যাংক নামে টিকিয়ে রাখা হয়। ব্যাংক, মেডিকেল ছাড়াও মহীউদ্দীন খান আলমগীর বেসরকারি ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির অনুমোদন নিয়েছেন, সেটিও চলছে নামকাওয়াস্তে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকটি নিয়ে কী হয়েছিল, তা অন্য সময় বিস্তারিত বলবেন। তাঁকে নানাভাবে জড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। তাঁর দাবি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো চলছে। এটাকে ভালো করার চেষ্টা আছে। আর এগুলোর বাইরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলছে বলে জানান তিনি।

সিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে মহীউদ্দীন খান বলেন, তিনি মূলত একাডেমিক বিষয়গুলো বিশেষ করে মেডিকেল কলেজটি দেখেন। হাসপাতাল দেখেন অন্যরা। মেডিকেল কলেজ এখন বন্ধ, দেশি-বিদেশি ছাত্ররা চলে গেছেন, আয় নেই। তবে কলেজে কিছু ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। কী রকম ঘাটতি জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা রকম শর্ত দেয়, আমরা সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করি। কিছু পারা যায়, কিছু পারা যায় না। এভাবেই চলছে।’

কোভিড ইউনিট স্থাপন, পরে পিছটান

হাসপাতালটিতে ১০০ শয্যার কোভিড ইউনিট চালু হলেও নিবিড় পরিচর্যা বা ভেন্টিলেটর, হাই–ফ্লো অক্সিজেন মিটার বা সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সুবিধা ছিল না। চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স নেই বললেই চলে। পিসিআর ল্যাব না থাকলেও সেই ঘোষণা দিয়ে কোভিড পরীক্ষা শুরু করা হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে মেডিকেল কলেজটির সাবেক উদ্যোক্তা এস এম বদরুদ্দোজা কোভিড চিকিৎসা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। 

বদরুদ্দোজা প্রথম আলোকে বলেন, গত সোমবার সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি কলেজ ও হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে চিঠি দিয়েছেন।

শর্ত অনুযায়ী, ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য চিকিৎসক থাকার কথা ১৫০ জন। বাস্তবে আছেন ৪০ জন, তা–ও বেশির ভাগই ধার করা। আর নার্স থাকার কথা ৩০০ জন। বাস্তবে আছেন ১৫ জন। চিকিৎসক বাদে মোট কর্মকর্তা–কর্মচারীর সংখ্যা ১০২। এই জনবল নিয়েই বাড়তি ১০০ শয্যার কোভিড ইউনিট খোলা হয়েছিল। 

হাসপাতালটির জেনারেল ম্যানেজার আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি টিমের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমাদের পিসিআর ল্যাব নেই। এখান থেকে শুধু নমুনা সংগ্রহ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রোগী তেমন পাওয়া যায়নি। তাই এর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিফায়েত উল্লাহ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। তাঁর মেইলে প্রশ্ন লিখে পাঠানো হয়। এরও জবাব পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, তিনি হাসপাতালে নেই। কোথায় আছেন, কীভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে, তাঁর সহকর্মীরা তা বলতে পারেননি। 

হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে কোভিড ইউনিট চালু হয়েছিল। তবে ওই চিঠি সংগ্রহ করে দেখা যায়, বিষয়টি তা নয়। গত ৬ জুন স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগ দেশের সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে একটি চিঠি দিয়ে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত ও জরুরি সেবা অব্যাহত রাখতে অনুরোধ জানায়। এই চিঠির ভিত্তিতে সিটি হাসপাতাল কোভিড চিকিৎসা শুরু করে।

গাজীপুরের সিভিল সার্জন মো. খায়রুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, সিটি মেডিকেলে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষা করার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। 

কেমন এই হাসপাতাল 

সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দুটি ভবন; একটি ভবন ইটাহাটা এলাকার বি-ব্লকে। ভাড়া করা এই ভবনটির মালিক মো. সাহাবুদ্দিন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী জাফর আলী জানান, করোনার কারণে ভবনটি বন্ধ। সেখানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয়।

ওই ভবন থেকে চান্দনা চৌরাস্তার দিকে এক-দেড় কিলোমিটার সামনেই আরেকটি ভবন। সেখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। নিচতলায় ফার্মেসি, বিলিং সেকশন, জরুরি বিভাগসহ কয়েকজন চিকিৎসকের চেম্বার। দ্বিতীয় তলায় হাসপাতালের চেয়ারম্যান, পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের অফিস। তৃতীয় তলায় রোগীদের ওয়ার্ড। চতুর্থ তলায় খোলা হয়েছিল করোনা ইউনিট। পুরো হাসপাতালের কোথাও ভর্তি রোগী পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালের পক্ষ থেকে গত বছরের আগস্টে গাজীপুর সিটি করপোরেশেনে ট্রেড লাইসেন্সের ফি জমা দেওয়া হয়, সেখানে এটিকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাত্র দুজন; একজন এফসিপিএস ডিগ্রিধারী, আরেকজন ডিপ্লোমাধারী। তাঁরা দুজনই কলেজের শিক্ষক, হাসপাতালের নন। তাঁরা সকালে কলেজে যান এবং বেলা আড়াইটার পর থাকেন না। অবেদনবিদ (অ্যানেসথেটিস্ট) আছেন একজন, তিনি সপ্তাহে চার দিন থাকেন।

>১০০ শয্যার কোভিড ইউনিট খুলে পরে পিছুটান
রিজেন্ট, জেকেজির পরিণতি দেখে কোভিড চিকিৎসা থেকে সরে আসে হাসপাতালটি

মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে হাসপাতালে ভর্তি কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। শত শত বিছানা খালি। বহির্বিভাগে গুটিকয়েক রোগী ছিলেন। কথা হয় গাজীপুরের মজলিশপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. সামছুদ্দিনের (৬০) সঙ্গে। নাতি ইমরান হোসেনকে নিয়ে সকাল ১০টার দিকে হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি। ইমরানের ডান চোখে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া। সামছুদ্দিন জানান, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে একজন চিকিৎসককে দেখতে পান। কিন্তু চোখের চিকিৎসা করার মতো কেউ সেখানে ছিলেন না।

হাসপাতালের এই দুরবস্থা কেন—জানতে চাইলে মহীউদ্দীন খান বলেন, এটি শ্রমঘন এলাকা। এখানে নিম্নবিত্তদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিশেষায়িত সেবা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল খুললেন কেন? তাঁর জবাব, এক দিনে তো আর সব হবে না। রাতারাতি কেউ ৫০০ শয্যা গড়ে তুলতে পারবে না। তা ছাড়া বিনিয়োগের প্রশ্ন আছে। 

চিকিৎসক, নার্স এত কম, আবার লাইসেন্সও নেই—এ প্রসঙ্গে মহীউদ্দীন খান বলেন, ‘চাইলেও তো চিকিৎসক–নার্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া এখন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে আয় নেই বললেই চলে। আর অনেক হাসপাতালেরই তো লাইসেন্স নেই। আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সময় এ ব্যাপারে সহযোগিতা পাইনি। তবে আমরা আবেদন করেছি, মৌখিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্য জানতে তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীর একান্ত সচিবের মাধ্যমেও মন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দুদিন অপেক্ষার পরও তাঁরা তা দিতে পারেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মৌখিক অনুমতিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল চলার সুযোগ নেই।

সিটি মেডিকেল কলেজটি অন্তত তিনবার পরিদর্শন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। পরিদর্শন অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে প্রবীণ এই চিকিৎসক বলেন, ‘কয়েক বছর আগে পরিদর্শন করতে গিয়ে নিয়ম-নীতিতে অনেক ঘাটতি পেয়েছিলাম। এ জন্য আমরা মেডিকেল কলেজের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করিনি। পরে কীভাবে পেয়েছে, তা বলতে পারব না।’

নিজস্ব ভবনও নেই

হাসপাতাল ও কলেজ করার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে নিজস্ব ভবন থাকা। কিন্তু কলেজ ভবনটি ভাড়া করা আর হাসপাতাল ভবনের পাঁচটি ফ্লোরের মালিক এস এম বদরুদ্দোজা। একটি ফ্লোরের মালিক কলেজ। নিয়ম অনুযায়ী, ভাড়া বাড়িতে কলেজ এবং হাসপাতাল করা যায় না।

তারপরও ভবন ছাড়া মেডিকেল কলেজ চলছে কীভাবে? জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জমি কিনে ভবন করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালে। সেটি হয়েছে কি না, তা পরবর্তী পরিদর্শনে জানা যাবে। এটা না হয়ে থাকলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

কলেজ ও হাসপাতালের জন্মবৃত্তান্ত

কলেজ ও হাসপাতাল ভবনে ঢুকতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরাল রয়েছে। এর নিচে নামফলকে লেখা আছে, গত ১৭ মার্চ এটি উদ্বোধন করেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। 

২০১১-১২ সালে চিকিৎসক এস এম বদরুদ্দোজা সিটি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পান। কলেজ ও হাসপাতাল চালুর পর তিনি সরকারদলীয় স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্রের কবলে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি মেডিকেল কলেজ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন মহীউদ্দীন খান কলেজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিনে নেন।

বদরুদ্দোজা প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করলেও জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে তা অনুমোদন হয়নি। পুরো টাকা বুঝে না পাওয়ায় তিনি সবকিছু বুঝিয়ে দিলেও কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তর করেননি। তবে ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর বদরুদ্দোজা কলেজ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন, মহীউদ্দীন আলমগীরকে তখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে টাকা লেনদেন শেষ না হওয়ায় তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যান হতে পারেনি। 

টাকা লেনদেনের বিষয়ে দুই পক্ষ মুখ খুলতে না চাইলে বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটির হস্তান্তর মূল্য ছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ক্রেতা বদরুদ্দোজা লেনদেনের বিষয়টি বলতে না চাইলেও তিনি জানান, পাওনা টাকার পরিমাণ আরও বেশি। 

এ প্রসঙ্গে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘বদরুদ্দোজা কলেজটি চালাতে না পেরে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। আলাপ-আলোচনা করে দেনা-পাওনা মিটিয়ে ফেলবেন।’

অনিয়মই সেখানে নিয়ম

হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদবি অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন রিফায়েত উল্লাহ শরীফ। প্রতিষ্ঠানটি হাতবদলের পর এ পর্যন্ত কোম্পানির কোনো সভা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদবি ব্যবহার করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ থেকে পাস করে বের হতে ১৫ বছর সময় নেন। 

নতুন ব্যবস্থাপনায় শরীফ এখন কলেজ ও হাসপাতালে মহীউদ্দীন খানের অংশীদার। ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মহীউদ্দীন খান এবং ১০ শতাংশের মালিক শরীফ। 

গত চার বছর কলেজ ও হাসপাতালের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা হয়নি। হাসপাতালের বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকা আয় হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বকেয়া পড়েছে।

এই হাসপাতালের এক টেকনিশিয়ান বলেন, ‘ছয় মাস ধরে বেতন বন্ধ। প্রতিদিনই বেতন চাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি না।’ 

মেডিকেল কলেজটি নিয়মিত পরিদর্শনও করা হয় না। সর্বশেষ ২০১৮ সালে পরিদর্শন করা হয়েছিল। এর কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক বলেন, আগেরবার পরিদর্শন করে নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেগুলো পূরণ করার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো কতটা প্রতিপালন করা হয়েছে, তা পরিদর্শন করে খুব শিগগির দেখা হবে।

২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে কলেজটির স্বীকৃতি একবার বাতিল করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর শর্ত পূরণ না হলেও একটি অঙ্গীকারনামা নিয়ে পরের শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতিবছর শর্ত পূরণ হয় না অথচ অঙ্গীকারনামা দিয়ে ছাত্রভর্তির সুযোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। 

পরিদর্শন শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব শর্ত দেয়, তার ৭০-৮০ শতাংশ মানলে তাঁরা ধরে নেন ঠিক আছে। কিন্তু এই মেডিকেল কলেজটি ৪০ শতাংশ শর্তও মানেনি। 

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. ইউনুস আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলতে আগ্রহী নন। 

প্রসঙ্গত, অধ্যক্ষের বয়স ৬৫ বছর পার হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তিনি অধ্যক্ষ পদে থাকতে পারেন না। 

কলেজ ও হাসপাতালের তিনটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে অবৈধভাবে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধন থাকা কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ পরিচালকের লিখিত রেজল্যুশনের ভিত্তিতে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। কিন্তু আগের কোম্পানির একমাত্র পরিচালক রিফায়েত উল্লাহ শরীফের স্বাক্ষরে স্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে। বাকি দুটি হিসাবও অবৈধ।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, এ-সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম হওয়া উচিত, ‘ইহাও একটি হাসপাতাল’। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের আইন-কানুন, প্রচলিত বিধিবিধান এই কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, অনুমোদন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি।