বিয়ে হচ্ছে কম, আনন্দোৎসব নেই

করোনার প্রার্দুভাবের পর বিয়ের সরঞ্জামের দোকানগুলো ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এলিফ্যান্ট রোডের এক দোকানে।  ছবি: প্রথম আলো
করোনার প্রার্দুভাবের পর বিয়ের সরঞ্জামের দোকানগুলো ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এলিফ্যান্ট রোডের এক দোকানে। ছবি: প্রথম আলো

এখন খুব কম পরিমাণে বিয়ে হলেও আনন্দোৎসব নেই। আগের মতো আয়োজনও নেই। করোনার দাপটে অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ।

লকডাউনের সময় বিয়ে বন্ধ ছিল। গত ৩১ মে থেকে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অল্প কিছু বিয়ে হচ্ছে। তবে বিয়ের কথা বললে—হৈ–হুল্লোড়, গায়েহলুদ, তোরণ, বাড়ি–গাড়ি–বাসর সাজানো, কার্ড বিতরণ, বউভাত, অতিথি আপ্যায়ন, দূরে–কাছের স্বজনদের মিলনমেলার যে চিরায়ত বিপুল আনন্দ–উৎসবের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা আর নেই।

এখন ঘরোয়া পরিবেশে ধর্মীয় রীতি মেনে প্রয়োজনীয় কাজটি সারা হচ্ছে। এতে যে কেবল জীবন থেকে এক অপার আনন্দই হারিয়ে গেছে তা–ই নয়, পাশাপাশি কাজি–পুরুত থেকে শুরু করে বিয়ের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়েছে। সব মিলিয়ে এখন বিয়ের বাজার ভালো নয়।

বিয়ে হচ্ছে মাত্র ৩ শতাংশ

সরকারের নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, দেশে বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বিয়ে হয়ে থাকে। সে হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে বিয়ে হয় ৪৫ থেকে ৪৬ হাজার।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, গত ২৬ মার্চ লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে ৩০ মে পর্যন্ত লকডাউন চলাকালে কেবল খুলনা ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি ছাড়া অন্য বিভাগগুলোতে কোনো বিয়ে হয়নি। লকডাউন উঠে গেলে গত জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত দেড় মাসে অন্তত ৬৮ থেকে ৬৯ হাজার বিয়ে হওয়ার কথা, সেখানে বিয়ের নিবন্ধন হয়েছে মাত্র প্রায় ২ হাজার ২০০, যা স্বাভাবিকের তুলনায় মাত্র ৩ শতাংশ। 

মুসলিম বিয়ে কাজিখানায় নিবন্ধন করতে হয়। দেশে নিবন্ধিত কাজি প্রায় সাত হাজার। কাজিদের সংগঠন বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির মহাসচিব ঢাকার সুপরিচিত মগবাজার কাজি অফিসের কাজি হাফেজ মওলানা সাগর আহমেদ জানালেন, সাধারণত শুক্রবার বিয়ের নিবন্ধন বেশি হয়। দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকাতেই বিয়ে হয় বেশি, এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে। কাজি সমিতির হিসাব অনুসারে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর ৩১ মে থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে বিয়ে নিবন্ধন হয়েছে ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ২০০–এর মতো।

ঢাকায় কাজি আছেন ১১৬ জন। প্রতি মাসে প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ বিয়ে হয়। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর দেড় মাসে যেখানে অন্তত দুই হাজার বিয়ে হওয়ার কথা, সেখানে ৪০০–এর কিছু বেশি বিয়ে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিয়ের নিবন্ধন হয় মগবাজার কাজিখানায়। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০টির মতো বিয়ে হয় এখানে। অথচ ৩১ মে থেকে ১৫ জুলাই অবধি বিয়ে হয়েছে মাত্র ২৬টি। অধিকাংশ কাজি অফিসে ২ থেকে ৪টি বিয়ে হয়েছে। আবার চকবাজার ও ইসলামপুরের কাজি অফিসসহ বেশ কিছু কাজি অফিসে এই দেড় মাসে একটিও বিয়ে হয়নি। জরুরি কারণ না থাকলে এখন কেউ বিয়ের ব্যবস্থা করছেন না। এ বিয়েগুলো হচ্ছে মূলত ঘরোয়া আয়োজনে। 

>বিয়ে হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ।
কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ
বিয়ের কার্ড, সামগ্রী, ফুলের ব্যবসা নেই
কাজিরা অর্থকষ্টে

কাজি সমিতির সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার পরে বেশি বিয়ে হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, প্রায় ৩০০। কম বিয়ে হয়েছে রংপুর বিভাগে, দেড় শর মতো। লকডাউনের সময় অনেক বিভাগে অনলাইন বিয়ের উদ্যোগ নিলেও কাজিরা এ ধরনের বিয়ের নিবন্ধন করেননি। কেবল খুলনা ও সিলেট বিভাগে বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে ১০–১২টি বিয়ের নিবন্ধন হয়েছে। 

করোনা পরিস্থিতিতে কাজিদের অবস্থাও কাহিল। তাঁরা সরকারি কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। উপরন্তু তাঁদের প্রত্যেককে প্রতিবছর নিবন্ধন ফিসহ প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা সরকারের কাছে জমা দিতে হয়। কাজিরা বিয়ের চার লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ওপর প্রতি হাজারে সাড়ে ১২ টাকা করে প্রায় ৫ হাজার টাকার মতো ফিস পান (চার লাখের ওপরে প্রতি লাখে ১০০ টাকা)। সবার বিয়ের দেনমোহর চার লাখ টাকা থাকে না। ফলে যে টাকা তাঁরা পান, তাতে অফিস ভাড়া, সহকারীদের বেতন দিয়ে চলা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এখন বিয়ে কমে যাওয়ায় কাজিদের খুব অর্থকষ্টের ভেতর দিয়ে দিন যাচ্ছে। সামাজিক কারণে কাজিরা কারও কাছে হাতও পাততে পারেন না। এ কঠিন সময়ে তাঁরা সরকারি প্রণোদনা চেয়েছেন।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের ক্ষেত্রে এমন নির্দিষ্ট কোনো ফিস নেই। মন্দিরে পুরোহিত বিয়ের আয়োজন করেন। রাজধানীর অধিকাংশ বিয়ে হয় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে। এই মন্দিরের পুরোহিত বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী জানালেন, লকডাউনের সময় কোনো বিয়ে হয়নি। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর মাত্র ৩টি বিয়ে হয়েছে। সাধারণ সময়ে মাসে এই মন্দিরে ৭ থেকে ১০টি করে বিয়ে হতো।

বিয়ে সামগ্রীর ব্যবসা নেই

বিয়ে মানেই জাঁকালো অনুষ্ঠান। বর–কনের গায়েহলুদ, বিয়ে, বউভাত সব মিলিয়ে প্রায় সপ্তাহজুড়ে আনন্দঘন আয়োজন। হলুদের ডালা–চালুন–কুলা, বরের শেরওয়ানি, পাগড়ি, পাজামা–পাঞ্জাবি, নাগরা, টোপরসহ প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর সবচেয়ে বড় বাজার এলিফ্যান্ট রোডে। কাঁটাবন মোড় থেকে বাটা সিগন্যাল মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এসব সামগ্রীর দোকানের সারি। আর বাটা মোড়ের শাহারা ট্রপিক্যাল সেন্টারের দুটি তলাজুড়ে কেবল বিয়ের সামগ্রীরই দোকান। সব মিলিয়ে এ এলাকায় দোকানের সংখ্যা ৫২।


সরেজমিনে দেখা গেল, বিয়ে কমে আসায় তাঁদের ব্যবসা প্রায় লাটে উঠেছে। মঙ্গলবার আলিফ জরি হাউসের মালিক আমিনুর রহমান, বধূ বরণের ওবায়দুল হাসান, বিয়ে বাড়ির জিয়াউর রহমানসহ প্রায় ১০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাধারণত তাঁদের দোকানে রোজ ন্যূনতম ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বা তার বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। এখন এসব সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে না। বেশ কিছু দোকান খোলাই হয় না।

বিবাহসামগ্রী বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন জানালেন, এই অর্ধশতাধিক দোকানে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার বিক্রি হতো। এখন অনেক দোকানে টানা এক সপ্তাহ ধরে কোনো বিক্রিই হয় না। সড়কের পাশে বা মার্কেটের সামনের দোকানগুলোতে কোনো দিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হয়, কোনো দিন হয়ই না। অনেক মালিক কর্মচারীর বেতন দিতে না পারায় তাঁদের ছুটি দিয়ে নিজেই দোকানে বসছেন। 

কমিউনিটি সেন্টার খুলে না দিলে বিয়েসামগ্রীর ব্যবসায়ীরা এ অবস্থায় আর বেশি দিন টিকে থাকতে পারবেন না। কমিউনিটি সেন্টার খুলে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে অনুষ্ঠান করার নিয়ম করা হলে তাঁদের ব্যবসা আবার চালু হতে পারে। এ ছাড়া তাঁদের টিকে থাকার কোনো বিকল্প নেই।

 কার্ডের দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে

একটা সময় ঈদে, নববর্ষে প্রিয়জনদের সুদৃশ্য কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর চল ছিল। মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের যুগ চালু হওয়ায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে সেই যুগ অচল হয়ে গেছে। এখন মূলত অনেকটাই নিয়ম রক্ষার্থে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিছু কিছু কার্ড পাঠনো হয়। কার্ডের ব্যবসা এখন বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে। বাংলাবাজারে প্রায় অর্ধশত ছোট প্রতিষ্ঠান এসব কার্ড ছাপিয়ে থাকে। এ ছাড়া কার্ড ছাপানোর খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে এখানে। গত সপ্তাহে বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেল, বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখানে কেউ আর কার্ড বা আমন্ত্রণপত্র ছাপাতে আসছেন না। এখানে প্রজাপতি কার্ডের মালিক দিলীপ কুমার আচার্য, ক্রিয়েটিভ প্রডাক্টের কাজী আলমাসুর রহমানসহ অনেকে জানালেন, তাঁরা প্রতি মাসে বিয়ে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর ৫০–৭০টি ফরমাশ পেতেন। বিভিন্ন প্রেস থেকে এসব কার্ড ছাপিয়ে নিতেন তাঁরা। এটা ছোটখাটো ব্যবসা। তবু এ থেকেই তাঁদের দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিয়ে সংসার চলে যেত। কাজ না পাওয়ায় এখন অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ইতিমধ্যে মেঘলা কার্ড সেন্টার, মদিনা কার্ড সেন্টার, ইরা কার্ড গ্যালারি, বিবাহ কার্ড সেন্টার, মাসুদ কার্ড সেন্টারসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। গত ২৬ মার্চ লকডাউনের পর থেকে আজাদ প্রডাক্টের একটি বিক্রয়কেন্দ্রও এখন পর্যন্ত খোলেনি। পুরানা পল্টনে তাঁদের প্রধান কার্যালয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোস্তফা কামাল জানালেন, কার্ডের ব্যবসা এখন মূলত বিয়ের কার্ডনির্ভর। সারা দেশে তাঁদের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র ৩০টি। এখন বিয়েই হচ্ছে না, বিক্রিও নেই। দোকান খুলে রাখলে বরং বাড়তি খরচ। তাই তাঁরা লকডাউন উঠে গেলেও দোকান বন্ধই রেখেছেন।

পুরানা পল্টনের আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান আইডিয়েল প্রডাক্টের বিক্রয়কেন্দ্র অবশ্য খোলা হচ্ছে। এর ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম খান জানান, দিনে যেখানে তাঁর অন্তত নানা রকম কার্ডের প্রায় শ খানেক ফরমাশ পেতেন, এখন তার কিছুই পাচ্ছেন না।

নেই ফুলশয্যা

বিয়ের অনুষ্ঠানই যখন বন্ধ, তখন ফুলশয্যা বা ফুল দিয়ে বর–কনের মঞ্চ সাজানো, বরের গাড়ি সাজানোর সুযোগটি কোথায়! নেই সেই সুযোগ। তাই ফুল ব্যবসায়ীদেরও খুব মন্দা সময় চলছে। রাজধানীতে শাহবাগে পাইকারি ও খুচরা ফুল বেচাকেনার সব থেকে বড় বাজার। এখানে খুচরা দোকান ৫১টি। বিক্রি এত কম যে এখনো ১০টি দোকান খোলেইনি। শাহবাগ ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানালেন, সাধারণত বুধবার কনের গায়েহলুদ, বৃহস্পতিবার বরের আর শুক্রবার বিয়ে—সপ্তাহে এই তিন দিন বিয়েকেন্দ্রিক বেচাকেনা হতো। অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি গাড়ি সাজানোর কাজ থাকত। বিয়ের গাড়ি সাজানোর খরচ ন্যূনতম এক হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাসরঘর, বর–কনের মঞ্চ, বিয়ের মালাগাঁথা—এসব মিলিয়ে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকার প্যাকেজের কাজ করতেন তাঁরা। এসব কিছুই আর হচ্ছে না। ব্যবসা খুবই খারাপ। নিদারুণ করোনাকাল বিপর্যস্ত করে তুলেছে তাঁদের জীবনযাত্রা।