সিলেটে করোনাভাইরাসের প্রভাব: ঈদবাজারে নেই গতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা

ঈদের বাজারে নেই মানুষের ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট নগরের হাসান মার্কেটে। ছবি: আনিস মাহমুদ
ঈদের বাজারে নেই মানুষের ভিড়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট নগরের হাসান মার্কেটে। ছবি: আনিস মাহমুদ

৩০ জুলাই, রাত আটটা। মূল সড়ক ধরে এপাশ-ওপাশ হচ্ছিল শত শত রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি, পিকআপ, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ নানা যানবাহন। হেঁটে চলছিলেন হাজারো মানুষ। পথচলতি মানুষের মধ্যে কেউ গরু-ছাগল কিনে বাসায় ফিরছিলেন। কেউবা আবার কোরবানির পশু কিনতে হাটে যাচ্ছিলেন।

এ দৃশ্য সিলেট নগরের কাজীরবাজার এলাকার। এখানেই নগরের সবচেয়ে বড় পশুর হাট অবস্থিত। হাটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ ব্যবসায়ী গরু আর ছাগল নিয়ে ক্রেতাদের প্রতীক্ষায় আছেন। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় কোরবানির পশু কিনতে মানুষের উপস্থিতি এবার কম বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তাঁরা এও বলেছেন, পশুর হাট বরাবরের সেই চিরচেনা জৌলুশ এবার হারিয়েছে। অনেকে দুদিন ধরে হাটে অবস্থান করে একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি।

পঞ্চাশোর্ধ্ব মনু মিয়ার বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায়। তিনি গত বুধবার দুপুরে কাজীরবাজারের পশুর হাটে পাঁচটি গরু নিয়ে এসেছেন বিক্রি করতে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত একটিও বিক্রি করতে পারেননি। মনু মিয়া জানান, করোনাভাইরাসের প্রভাব কোরবানির পশুর বাজারেও পড়েছে। তুলনামূলকভাবে ক্রেতাদের উপস্থিতি কম হওয়ায় বেচাকেনায় মন্দাভাব বিরাজ করছে। তবে আজ শুক্রবার ঈদের আগের দিন হওয়ায় বেচাকেনার পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।

একাধিক বিক্রেতা জানিয়েছেন, কোরবানির পশু কিনতে গতবারের চেয়ে অর্ধেকেরও কম ক্রেতা হাটে এসেছেন। বিক্রেতাদের উপস্থিতিও অন্যবারের চেয়ে কম। অনেকে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পশুর হাটে আসছেন না। এ সুযোগে এবার সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লায় ভ্রাম্যমাণ কিছু পশুর অস্থায়ী হাট বসেছে। ভিড় এড়াতে অনেকে কাজীরবাজারের মতো ঐতিহ্যবাহী হাটে না এসে অস্থায়ী সেসব হাট থেকে কোরবানির পশু কিনছেন। ঝুঁকি এড়াতে অনেকে আবার শহরতলির বিভিন্ন গ্রাম থেকে কোরবানির জন্য গরু ও ছাগল কিনছেন।

গরু বিক্রেতাদের কথার সত্যতা টের পাওয়া যায় কাজীরবাজারের পার্শ্ববর্তী তালতলা এলাকার ফুটপাতে বসে থাকা ঘাস বিক্রেতা নুরুল আমিনের (৩৫) ভাষ্যে। জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকার বাসিন্দা নুরুল জানান, কয়েক বছর ধরেই তিনি এখানে পবিত্র ঈদুল আজহার আগে ঘাস বিক্রি করে থাকেন। অন্যান্য বছর প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার ঘাস বিক্রি করতেন। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে তিনি ঘাস বিক্রি করতে বসে রাত আটটা পর্যন্ত এক আঁটি ঘাসও বিক্রি করতে পারেননি। প্রতি আঁটি ঘাসের দাম ১০ ও ৫০ টাকা। নুরুল বলেন, ‘এবার গরুও কম, ক্রেতাও কম। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।’

করোনা পরিস্থিতিতে কেবল গরুর হাটেই মন্দা নয়, বরং প্রতিটি ব্যবসা খাতেই ধস নেমেছে বলে মন্তব্য করেছেন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিগত বছরগুলোতে যে বেচাকেনা হতো, এর চার ভাগের এক ভাগও এবার হয়নি। এতে সব ধরনের ব্যবসায়ীরা চরম বিপর্যয়ে পড়েছেন। দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতারা ভয়ে আসছেন না। ফলে দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার পর ঈদবাজার ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হওয়ার যে প্রত্যাশা করেছিলেন ব্যবসায়ীরা, সেটা পূরণ হলো না। মাঝখানে আবার বন্যার প্রভাবেও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আশা করেছিলেন, করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ঈদকে কেন্দ্র করে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে।

চেম্বারের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঈদের আগের কয়েক দিন পশুর হাট ছাড়া নগরে গড়ে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার বেচাকেনা হতো। এবার সেটা প্রায় ২ থেকে ৩ কোটিতে নেমেছে। অথচ তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সারা দেশের মতো নগরের মুদি, মাছ, সবজি ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এতে করে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র সকল ধরনের ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এই ঈদবাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য গতি না পাওয়ায় চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। মূলত করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন সব ধরনের ব্যবসাতেই ধস নেমেছে।

গতকাল রাত আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত নগরের জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, নয়াসড়ক, কুমারপাড়া, হাওয়াপাড়া ও লামাবাজার এলাকার বিপণিবিতানে পোশাক, কসমেটিকস ও জুতার দোকানে সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় দোকানেই ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাড় চলছে। নানা ধরনের আকর্ষণীয় ছাড়ের প্রলোভন সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোর মতো ক্রেতাদের রমরমা উপস্থিতি নেই। আগামীকাল শনিবার ঈদ, অথচ বিপণিবিতানগুলো অনেকটাই ফাঁকা পড়ে রয়েছে।

জিন্দাবাজার এলাকার একটি পোশাকের দোকানের বিক্রয়কর্মী আফরোজ আহমদ জানান, তাঁদের দোকানে ৫০ শতাংশ ছাড় চলছে। অথচ গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না। অথচ গত ঈদেও এ সময়টাতে প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছিল। আজ ঈদের আগের দিন। তাই বেচাকেনা কিছুটা বাড়ার প্রত্যাশা করছেন তাঁরা। তিনি আরও জানান, অধিকাংশ দোকানেই ক্রেতা নেই, তাই ঈদের বেচাকেনার সময়টাতেও অলস সময় পার করছেন দোকানিরা।

পশু নিয়ে অপেক্ষায় বিক্রেতা। ক্রেতা কম থাকায় অলস সময় পার করছেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট নগরের সবচেয়ে বড় কোরবানির পশুর হাট কাজীরবাজারে। ছবি: আনিস মাহমুদ
পশু নিয়ে অপেক্ষায় বিক্রেতা। ক্রেতা কম থাকায় অলস সময় পার করছেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেট নগরের সবচেয়ে বড় কোরবানির পশুর হাট কাজীরবাজারে। ছবি: আনিস মাহমুদ

নয়াসড়ক বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহিউদ্দিন সেলিম জানান, নয়াসড়ক ও জেলরোড এলাকাতে আড়ংসহ নগরের অভিজাত পোশাকের দোকানগুলো মূলত অবস্থিত। এ এলাকায় মোট ৪৫টি গুরুত্বপূর্ণ পোশাকের দোকানের অবস্থান। ফলে, দুই ঈদের আগের সময়টাতে এখানে ক্রেতাদের ভিড়ে রাস্তায় হাঁটাচলা করা যায় না। অথচ এবার সেই চিরচেনা ভিড় নেই। বেচাকেনা অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। তবে সেই অর্থে ব্যবসা-বাণিজ্য না হলেও করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন দোকানপাট বন্ধ থাকার পর এ সামান্য বেচাকেনাও ব্যবসায়ীদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

বিগত বছরগুলোয় ঈদের আগে দরজি দোকানে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও এবার তা ছিল না। এমনকি পারলার ও সেলুনগুলোয় ঈদের আগে রাতে ভিড় থাকলেও এবার তা না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা। সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি স্বর্ণলতা রায় প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটের পারলার ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তদের ৯০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। করোনাভাইরাসের কারণে গত ঈদুল ফিতরের সময় পারলার ও সেলুনগুলো বন্ধ ছিল। এই ঈদের আগে দোকানগুলো চালু হলেও ঝুঁকি এড়াতে অনেকেই আসবেন না। তাই এ খাতের ব্যবসায়ীরা চিন্তায় রয়েছেন। এ অবস্থায় রূপচর্চার কাজে নিয়োজিত অসংখ্য তরুণী বেকার হয়ে পড়েছেন।