দিনগুলোকে 'নিউ নরমাল' হিসেবে মেনে নিয়েছেন তাঁরা

মুঠোফোনে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির খোঁজ নিচ্ছেন চিকিৎসক রাইনা মাসনুন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ছবি: প্রথম আলো
মুঠোফোনে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির খোঁজ নিচ্ছেন চিকিৎসক রাইনা মাসনুন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে প্রথম করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ১০ এপ্রিল। সংক্রমিত ব্যক্তিটি ছিলেন থানা-পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার একজন। সেই থেকেই চিকিৎসক রাইনা মাসনুনের ব্যস্ততা শুরু। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালট্যান্ট। স্বাভাবিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তাঁকে দেওয়া হয় করোনা রোগীর চিকিৎসা এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার দায়িত্ব। সেই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চার মাস ধরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চিকিৎসক রাইনার প্রতিটি দিন কাটছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায়। ইতিমধ্যে তিনি করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন।

বাবা ও মাকে নিয়ে রাইনার সংসার। তাঁরা থাকেন ঢাকায়। করোনাকালে আর মা-বাবার সান্নিধ্য পাওয়া হয়ে ওঠেনি রাইনার। এদিকে ঈদ চলে এসেছে। বিশেষ এই দিনটিতেও তিনি থাকবেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সময় কাটাবেন আইসোলেশন ইউনিটে থাকা করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে। আর নিত্যদিনের মতো মুঠোফোনে খোঁজ নেবেন করোনা শনাক্ত হলেও নিজ বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া লোকজনের।

ঈদের সময়টা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং করোনা রোগীদের সেবায় সময় কাটানোর অনুভূতি কেমন হবে চিকিৎসক রাইনা মাসনুনের? প্রশ্নটা শুনে কিছুটা সময় চুপসে ছিলেন তিনি। এরপর বললেন, ‘এটাই নিউ নরমাল। দিনগুলোকে এখন নিউ নরমাল হিসেবে মেনে নিয়েছি।’

পরে বলে চললেন, কোভিড বিশ্বব্যাপী এক মহামারি। এই একটি ভাইরাস সবার জীবনাচরণে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন মানুষ যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটি তারা যত দ্রুত জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে, ততই মঙ্গল। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, একসময় হয়তো করোনা বিদায় নেবে। কিন্তু মানুষ শিগগির আগের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। এই পরিবর্তনটাকেই এখন স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তা-ই বলছে। সুতরাং ঈদে আপনজনের সান্নিধ্যে যেতে না পারাসহ করোনার কারণে উদ্ভূত সব নতুন পরিস্থিতি মেনে নেওয়াটাই ‘নিউ নরমাল’ এই চিকিৎসকের কাছে।

কাজ করতে গিয়ে রাইনা মাসনুমের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন আছে, তেমনি সুখস্মৃতি হিসেবে মনে রাখার মতো ঘটনাও কম নয়। যেমন আইসোলেশন ইউনিটে থাকা এক করোনা রোগী তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলতে চেয়েছিলেন। আরেকজনের আবদার ছিল কিছুটা ভিন্ন। সুরক্ষার জন্য রোগী, চিকিৎসকসহ সবাইকে সব সময় মাস্ক পরে থাকতে হয়। তাই রোগীরা চিকিৎসক রাইনার কণ্ঠ শুনতে পেলেও মুখ দেখতে পারেননি কখনোই। ওই করোনা রোগীর আবদার, রাইনার মুখখানি এক নজর দেখবেন। তাই মাস্ক খুলে দূরত্ব বজায় রেখে কিছু সময়ের জন্য তাঁর সামনে দাঁড়ানোর অনুরোধ। রাইনা বললেন, ‘করোনা বাস্তবতায় আমি তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি।’

করোনাকালে রোগীদের সুখ-দুঃখের আরেক সাথি লুৎফর রহমান। তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনিশিয়ান। শুরু থেকেই তাঁর নেতৃত্বে নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করেছেন ৩ হাজার ৬ জনের। এর মধ্যে করোনায় সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৫৫৫ জন। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ১৪ জন। সুস্থ হয়েছেন ৫০৪ জন। সংক্রমিত, মৃত্যু ও সুস্থ—এই তিন সূচকেই জেলার মধ্যে শীর্ষে ভৈরব। কঠিন এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলেছেন লুৎফর রহমান। তাঁর সহযোগী হিসেবে আছেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আনোয়ার হোসেন ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট মো. নাকিব।

সন্দেহভাজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর নমুনা সংগ্রহ করছেন মেডিকেল টেকনিশিয়ান লুৎফর রহমান। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ছবি: প্রথম আলো
সন্দেহভাজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর নমুনা সংগ্রহ করছেন মেডিকেল টেকনিশিয়ান লুৎফর রহমান। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ছবি: প্রথম আলো

লুৎফর রহমানের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায়। কর্মসূত্রে পরিবার নিয়ে তিনি এখন ভৈরবে। স্ত্রী, পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে আর দুই বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। পৃথক ঘরে থাকেন লুৎফর। সন্তানেরা কাছে আসতে চাইলেও নিষেধ করেন। তাই মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয়ে যায়।

লুৎফর রহমান বললেন, ‘শুরুর দিকে নমুনা দিতে দীর্ঘ সারি দেখে ভয় হতো। লোকজন ধৈর্যহারা হয়ে পড়তেন। তাঁদের সামাল দেওয়া কঠিন ছিল। এমনও হয়েছে, সড়কে লাশ পড়ে আছে। রাত ১০টা বেজে গেছে। কেউ কাছে যাচ্ছে না। তখন আমাকে গিয়ে সেই মৃত ব্যক্তির নমুনা আনতে হয়েছে। মানবিক বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ হতে পারে, করোনা না এলে হয়তো এ জীবনে সেই অভিজ্ঞতা পেতাম না।’

ঈদের দিনটা কীভাবে কাটবে লুৎফরের? এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব নেই তাঁর কাছে। তাঁর ধারণা, দিনটা আইসোলেশন ইউনিটেই কাটাতে হবে। সুযোগ মিললে বাসায় যেতেও পারেন। তবু আর দশটা ঈদের দিনের মতো হবে না। নিজেকে বিচ্ছিন্নই রাখতে হবে পরিবার-পরিজন থেকে।