'এবার ঈদ ঈদ লাগে'

ঈদুল ফিতরের সময়ে ইউসুফ মিয়ার দিনে আয় ছিল দু শ থেকে তিন শ টাকা। রিকশার প্যাডেল পা চালানোর জীবনে তাঁর কোনো দিন এমন ঈদ আসেনি। তবে এবার তাঁর কাছে ঈদ ঈদ লাগছে। যদিও এখনো ইউসুফের জীবন অবস্থা আগের অবস্থায় ফেরেনি। করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই ঈদুল ফিতরের আগে জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কেনাকাটা, বাজার থেকে শুরু করে ঈদের আমেজ এবার চারদিকে।

মার্চে বাংলাদেশে করোনার আগমন ঘটে। দীর্ঘদিন সব বন্ধ ছিল। ইউসুফ মিয়াও রিকশা নিয়ে বের হননি অনেক দিন। কিন্তু ঘরে বসে থাকলে যে পেট চলবে না। ঘরে তিন সন্তান, ওদের মুখেও খাবার তুলে দিতে হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ মাসের ঘর ভাড়া বাকি। পোলাপানরে পড়াই। একলার কামাইয়ে আর কত বইয়া থাকন যায়। বন্ধের মইধ্যে কোনো দিন খেপ পাইতাম, কোনো দিন পাইতাম না। ঈদের আগ দিয়া দুশো, তিন শ আয় হইতো।’ তবে ঈদুল আজহায় পরিস্থিতি ভিন্ন। অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, গণপরিবহন সব চলছে। ইউসুফ মিয়ারও আয় আগের চেয়ে কিছু বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘চাইরশো-পাঁচশো পাই অহন। দুই মাস খাওনের চিন্তায় অস্থির থাকতাম। এইবার সেই চিন্তা নাই। গত ঈদে মানুষ আছিল না রাস্তায়। এইবার মানুষ কোরবানি দিব, হাট-বাজার করে, ঈদ ঈদ লাগে। ছোট মাইয়ারে একটা জামাও কিন্যা দিছি।’

মার্কেটগুলোয় ঈদের মতো বেচাকেনা না হলেও মানুষের সমাগম ছিল। শেষদিকে এসে কেনাকাটাও কিছুটা বাড়ে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে আয় এখন হচ্ছে তা দিয়ে কর্মচারীদের খরচ দেওয়াসহ নিজেদের পরিবারের খরচ মেটাবেন।

ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পশু কোরবানি দেওয়া। ঈদের সপ্তাহ দু-এক আগে থেকেই হাটগুলো জমে ওঠে। ঈদের ঠিক কয়েক দিন আগ দিয়ে রাজধানীর সড়কে গরু বা ছাগলের দড়ি হাতে মানুষজনকে দেখা যায়। এবার হাটও বসেছে তবে সেখানে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল নানান বিধি। পশু বিক্রিও কম হয়েছে। আর্থিক সংকটের ধাক্কা এবার কমবেশি সবার ওপর দিয়েই গিয়েছে। যেসব বাড়িতে আগে পাঁচ থেকে ছয়টি পশু কোরবানি হতো সেখানে এবার দু বা তিনটি হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. নুরুজ্জামানের কাপড়ের ব্যবসা এবং সাততলা একটি বাড়ি আছে। বাড়িভাড়া এবং ব্যবসা দিয়ে তাঁর ভালোই চলছিল। প্রতিবছর পাঁচটি গরু কোরবানি দেন। কিন্তু করোনা এবার তাঁকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। বাড়ির গ্যারেজে তাঁর দুইটা গরু বাধা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসা তো নাই-ই। ঈদের আগে দম ফেলার সময় পাইতাম না। এইবার দোকানেই যাই না। কর্মচারীরাই দেখতেছে। চারটা ফ্ল্যাট খালি হইছে। অনেক ভাড়াটিয়ারা পুরো ভাড়া দিতে পারতেছে না। সবারই তো অবস্থা খারাপ। কোরবানির সময় নাতিদের নিয়ে আনন্দ করে কোরবানি দিই। রাত নয়টা- দশটা পর্যন্ত গোশত বিলানোর কাজ করি। কিন্তু এইবার দুইটা গরু দিতে গিয়াই আমার চিন্তা করতে হইছে।’

এবার সড়কে ছাগলের প্রচুর দেখা মিলছে। রাসেল স্কয়ারে আসলাম আকন, মো. মোরশেদ ও সেলিম কাদের কেরানীগঞ্জ থেকে ১০টি ছাগল নিয়ে এসেছেন। বিক্রির আশায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরছেন তাঁরা। স্থানীয় একজনের থেকে পাঁচটি এবং বাকি পাঁচটি তাঁদের তিনজনের। বেলা ১টা পর্যন্ত তিনটি বিক্রি করেছেন। মো. মোরশেদ বলেন, ‘দামও বেশি চাই না। জানি মানুষের হাতে টাকা নাই। কিন্তু তারপরও দাম শুইনা মানুষ হাইটা যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত সব বেচতে পারুম মনে কয়।’

ঈদের দিন নানান পদের রান্না হবে। বাজারগুলোতেও ভিড় জমেছে। মশলা, সেমাই, চিনিসহ অনেক কিছুই কিনছে মানুষ। জিগাতলার মা জেনারেল স্টোরের মাইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ঈদের চেয়ে এবার বেশি বিক্রি হচ্ছে। বহু মানুষের হাতে পয়সা ছিল না। কিন্তু এইবার তো মানুষ কাজে নামছে। বিক্রিও ভালো হচ্ছে। গতবার ঈদের আমেজ বোঝা যায় নাই। কিন্তু এইবার ঈদের মতো মনে হচ্ছে।’

ঈদুল আজহায় এবার দেখা গেল পাড়ায় পাড়ায় বেশ কিছু লোক কাজের সন্ধানে ঘুরছে। তারা গোশত কাটার কাজ করতে চায়। ধানমন্ডির আট নম্বর সড়কে দেখা গেল পাঁচজন ঘুরছেন। এদের একজন মো. কামাল বলেন, ‘আমি রাস্তায় রাস্তায় পান বেচি। মানুষ কইমা গেছে। ঈদের দিন যদি গোশত কাইটা কিছু পয়সা পাই, হেই আশায় বাইর হইছি। যদি কারও বাড়িতে কাজ পাই।’ কামালের মতো তাঁর সঙ্গীরাও ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষ। কোরবানির উপলক্ষে যদি দুটো দুটো পয়সা আয় করা যায় সেই আশায় ঘুরছেন।