ঈদে চোখে পড়বে আ.লীগ-বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা

দলীয় পাঁচ সাংসদের মৃত্যুর পরপরই শূন্য হওয়া আসনগুলোয় মনোনয়ন পেতে জোর চেষ্টা-তদবির শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। অনেকে প্রয়াত সাংসদের জন্য শোক জানিয়ে নিজের ছবিসহ পোস্টার ও ব্যানার টাঙিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৫ ও ১৮ আসনে প্রার্থীদের তৎপরতা বেশি ক্ষমতাসীন দলে। একই অবস্থা বিরোধী দল বিএনপিতেও।

যদিও নির্বাচনের যাওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি, তবু ঢাকা মহানগরীর উত্তর ও দক্ষিণের দুই প্রান্তের দুটি আসনে দলের মনোনয়ন পেতে এরই মধ্যে সক্রিয় হয়েছেন অন্তত ছয়জন নেতা। অনেকে নির্বাচনী এলাকার জনগণকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টারও লাগিয়েছেন। তবে বিএনপির চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা বেশি। দুটি আসনে অসংখ্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা এবং দল-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীরা প্রথমে প্রয়াত সাংসদের জন্য শোক জানিয়ে এলাকায় পোস্টার ও ব্যানার টাঙিয়ে নিজের প্রচার করছেন। এরপর সাধারণ বাসিন্দাদের নামে ‘এমপি হিসেব দেখতে চাই’ বলে পোস্টার লাগান।

করোনা মহামারির মধ্যেই গত চার মাসে ঢাকার দুজনসহ আওয়ামী লীগের পাঁচজন সাংসদ মারা যান। তাঁরা হলেন শামসুর রহমান শরীফ (পাবনা-৪), হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫), মোহাম্মদ নাসিম (সিরাজগঞ্জ-১), সাহারা খাতুন (ঢাকা-১৮) ও মো. ইসরাফিল আলম (নওগাঁ-৬)। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথমে পাবনা-৪ ও ঢাকা-৫, এরপর সিরাজগঞ্জ-১ ও ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচন হবে। সবশেষে হবে নওগাঁ-৬ আসনে। এ আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম ২৭ জুলাই মারা যান। এর মধ্যে পাবনা-৪ ও ঢাকা-৫ আসনের নির্বাচন করোনার কারণে পিছিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দুটি আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। সিরাজগঞ্জে মোহাম্মদ নাসিমের আসনে ছেলে তানভীর শাকিলের প্রাথী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি আগেও একবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সাংসদ হয়েছিলেন। পাবনায় শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী কামরুন নাহার, মেয়ে মেহজিবন শিরিন, ছেলে গালিবুর রহমান ও মেয়ের জামাতা আবুল কালাম আজাদও প্রার্থী হতে তৎপর। এর বাইরে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) এ এস এম নজরুল ইসলাম ও জেলা পরিষদের সদস্য রেজাউল করিমও মনোনয়ন চাইবেন।

ঢাকায় তৎপরতা বেশি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৬ মে হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুর পর ঢাকা-৫ (ডেমরা-দনিয়া-মাতুয়াইল) আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই আসনে আগ্রহী প্রার্থীদের তালিকা যত লম্বাই হোক, শেষ পর্যন্ত চারজনের মধ্যেই প্রার্থিতা সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তাঁদের মধ্য আছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, সাধারণ সম্পাদক হারুন উর রশীদ মুন্না ও প্রয়াত হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে মশিউর রহমান মোল্লা ওরফে সজল মোল্লা। তাঁদের মধ্যে এক বিবেচনায় মনিরুল ইসলাম এগিয়ে আছেন।

তিনি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা হাবিবুর রহমান মোল্লা দলের সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রার্থী হন। তা মেনে নেন মাঠপর্যায়ের পুরোনো ও নিবেদিত নেতা মনিরুল ইসলাম। এখন তিনি মনে করেন, এবারের মনোনয়ন তাঁর প্রাপ্য।

কিন্তু দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ায় মনিরুল ইসলামের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। যদিও আবু আহমেদ পাশের ঢাকা-৬ আসনের ওয়ারী এলাকার পুরোনো বাসিন্দা। এ ছাড়া মোল্লা পরিবারও আসনটিতে একটা ব্যাপার। বয়সে তরুণ হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে সজল মোল্লাও মনোনয়ন চাইবেন। তিনি ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

আবু আহমেদ মান্নাফী প্রথম আলো বলেন, ‘৫৫ বছর রাজনীতি করছি, সংসদে যাওয়ার বয়সও হয়েছে মনে করি। আমার ইচ্ছা আছে নির্বাচন করার। মনোনয়ন পেলে করব। কাজী ফিরোজ রশীদ যদি গোপালগঞ্জ থেকে এসে এখানে নির্বাচন করতে পারেন, আমার ওয়ারি থেকে যাত্রাবাড়ী কত দূর।’

এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার নবীউল্লাহ। এবারও তিনি সম্ভাব্য প্রার্থী। তাঁর সঙ্গে ওই এলাকার সাবেক সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমেদ ও শিক্ষক সংগঠনের নেতা সেলিম ভূঁইয়াও মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। দল চাইলে নির্বাচন করবেন বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার।

অনেকের দৃষ্টি ঢাকা-১৮ আসনে
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের অনেকের দৃষ্টি ঢাকা-১৮ আসনের দিকে। এ আসনে সাংসদ সাহারা খাতুন মারা যান ৯ জুলাই। এরপরই শোক জানিয়ে নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের ছবিসহ ব্যানার, পোস্টার লাগিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান, ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান ও আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে খসরু চৌধুরী। এর মাধ্যমে তাঁরা মূলত নিজেদের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছার কথা জানান দিয়েছেন। এর বাইরে মনোনয়ন পেতে তৎপর উত্তরার বাসিন্দা যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান এস এম তোফাজ্জল হোসেন। একসময় তাঁকে সাহারা খাতুনের পরের নেতা মনে করা হতো। কিন্তু জীবদ্দশায় সাহারার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণখান ইউনিয়ন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি স্থানীয় ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়ে হারার পর আগের অবস্থান অনেকটা হারিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে মনোনয়ন দিতে গেলে এই চারজনের মধ্য থেকে বিবেচনা করতে হবে। এর মধ্যে উত্তরার বাসিন্দা হাবিব হাসান সাংগঠনিক লোক। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের জন্য ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষ কাজ করছে। খসরু চৌধুরী প্রয়াত সাহারা খাতুনের অন্যতম ঘনিষ্ঠজন এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এলাকায় তাঁর বড় তৈরি পোশাকের কারখানা, স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং হাসপাতাল রয়েছে। এসব কারণে খসরু চৌধুরী এলাকায় বেশ আলোচিত।

খসরু চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে আমি প্রয়াত সাহারা খাতুনের সহযোগী হিসেবে পাশে ছিলাম। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এলাকায় আমার অবস্থান, অবদান এবং কাজের মূল্যায়ন করবে বলে আশা করি।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১, ১৭, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড এবং উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, তুরাগসহ উত্তরা এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৮ আসন। রাজধানীর পশ্চাৎপদ এই আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু নিজে থেকে মুখ খুলছেন না। এর মধ্যে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নাম বলাবলি হচ্ছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কেউ নিজের কথা মুখ খুলে বলবেন না। কিন্তু তাঁরা প্রার্থী হতে চান। নেত্রী মনোনয়ন দিলে করবেন।

সাহারা খাতুনের সঙ্গে গত নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন। তিনি মাঠে নেই। বিএনপি থেকে এই আসনে আগে থেকে তৎপর জাতীয়তাবাদী যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। এলাকায় ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রঙিন পোস্টার লাগিয়েছেন দক্ষিণখানের আদি বাসিন্দা ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম কফিল উদ্দিন আহম্মেদ। মনোনয়ন চাইবেন ব্যবসায়ী বাহাউদ্দিন সাদী। তিনি গিয়াস উদ্দিন মামুনের আত্মীয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করেছিলেন।

কফিল উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নির্বাচন করার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি। দল যদি নির্বাচন করে, আমি প্রার্থী হব।’

অবশ্য বিএনপি উপনির্বাচনগুলোয় অংশ নেবে কি না, তা এখনো ঠিক হয়নি। এর আগে বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনে প্রার্থী দিয়েও তারা করোনা মহামারির কারণ দেখিয়ে নির্বাচন করেনি। এখন আবার নতুন করে পাঁচটি উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সংশয় আছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, এখনো সে সিদ্ধান্ত হয়নি। আসল কথা হচ্ছে, এখন তো কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। মানুষ ভোট দিতে যায় না। অথচ নির্বাচন হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন। কমিশন মহামারি পরিস্থিতিতেও ইলেকশনের নামে সিলেকশনের পথে। এটি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু না।’