'কষ্টের মাঝে আইছে ঈদ, আমরার ত ঈদ নাই'

করোনার সঙ্গে বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় নেই ঈদের আমেজ। গত বৃহস্পতিবার জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের রায়পুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
করোনার সঙ্গে বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় নেই ঈদের আমেজ। গত বৃহস্পতিবার জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের রায়পুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

‘এক মাসে তিনবার বইন্যা অইছে। তিনবার ঘরও পানি ঢুকছে। বন্যাত ঘরদুয়ার ভাঙছে। ইতা কিলা ঠিক করতাম। হাত খালি। কোনো টাকাপয়সা নাই। খাইয়া, না খাইয়া দিন যার। এই কষ্টের মাঝে আইছে ঈদ। আমরার ত আসলে ঈদ নাই, কিলা বাঁচতাম অউ চিন্তায় আছি।’

কথাগুলো সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের রায়পুর নতুনহাটি গ্রামের বর্গাচাষি আবদুর রহিমের (৫৫)। তিনি জানালেন, এমনিতেই করোনার কারণে হাওর এলাকার মানুষ চার মাস ধরে কর্মহীন; তার ওপর তিন দফা বন্যায় লোকজন কাহিল। অনেকের ঘরে খাবার নেই। বন্যায় বসতবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় ঈদ নিয়ে হাওরপাড়ের মানুষের মনে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকার কথা, সেটি এবার নেই।

আবদুর রহিম বলেন, বোরো মৌসুমে পাওয়া ধান দিয়ে দুই থেকে তিন মাস চলে। এরপর তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু এবার করোনার কারণে এলাকায় কোনো কাজ নেই। তিনি নিজে সাতজনের পরিবার নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। ধারদেনা করে চলছেন। এই অবস্থা শুধু তাঁর একার নয়, হাওর এলাকার বেশির ভাগ মানুষের।

সুনামগঞ্জে গত ২৫ জুন প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয়। পরিস্থিতির উন্নতি হতে না হতেই পরপর আরও দুই দফা বন্যার কবলে পড়ে হাওর এলাকার মানুষ। এখনো হাওর এলাকার রাস্তাঘাট, মানুষের বাড়িঘর থেকে পুরোপুরি বন্যার পানি নামেনি। অনেক মানুষ রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। অন্তত দুই হাজার পরিবারের লোকজনের ঈদ কাটবে আশ্রয়কেন্দ্রে।

রায়পুর নতুনহাটি গ্রামের দিনমজুর শামসুল ইসলামের স্ত্রী আয়েশা বেগম (৩৫) জানালেন, দুই সন্তানসহ তাঁদের চারজনের পরিবার। স্বামীর আয়েই সংসার চলে। ঘরে কোনো চাল নেই। এখন ঘরের সংস্কারকাজই কীভাবে করবেন, কীভাবে বাচ্চাদের নিয়ে খেয়েপরে বাঁচবেন এই চিন্তার অস্থির। শামসুল ইসলাম বলেন, সারা দিন হাওরে মাছ ধরে দিনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। তা দিয়েই টেনেটুনে চলছেন। তিনি বলেন, বাচ্চাদের একটা জামাকাপড় কিনে দেবেন, ঈদের দিনে একটু ভালোমন্দ খাওয়াবেন, এই সামর্থ্য তাঁর নেই।

গ্রামের প্রবীণ সোনাহর আলী (৭০) জানলেন, এই গ্রামের প্রায় সবাই দরিদ্র মানুষ। কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর, কেউবা হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু করোনার কারণে মানুষের কোনো কাজ নেই। তার ওপর তিনবারের বন্যা লোকজনের একেবারে কোমর ভেঙে দিয়েছে। এ অবস্থায় ঈদ নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার মানসিকতা এসব মানুষের নেই। সামনের দিন কীভাবে চলবেন, এই নিয়ে চিন্তিত তাঁরা।

স্থানীয় ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রণজিৎ চৌধুরী বললেন, হাওর এলাকার মানুষ খুব কষ্টে আছে। করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে তারা কর্মহীন। এরপর বন্যা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এর আগে হাওর এলাকায় এভাবে এত দীর্ঘ সময় বন্যার পানি থাকেনি। মানুষ এতটা অসহায় অবস্থায় পড়েননি।

জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম জানান, এখনো মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটে বন্যার পানি রয়েছে। নানাভাবে লোকজন ভোগান্তি পোহাচ্ছে। ঈদ নিয়ে মানুষের মধ্যে অন্য সময় যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখ যেত, এবার সেটা নেই। তিনি আরও জানান, তাঁর ওয়ার্ডে চারটি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৫৫টি পরিবার রয়েছে। বাড়িঘরে বন্যার পানি থাকায় এসব মানুষ ফিরতে পারেনি। আশ্রয়কেন্দ্রেই তাদের ঈদ কাটবে।

করোনার সঙ্গে বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় নেই ঈদের আমেজ। গত বৃহস্পতিবার জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের রায়পুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
করোনার সঙ্গে বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় নেই ঈদের আমেজ। গত বৃহস্পতিবার জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের রায়পুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার উত্তর শ্রীপুর ইউপির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খসরুল আলম জানান, তাঁদের উপজেলার তিনটি শুল্ক স্টেশন এবং জাদুকাটা নদীতে বালু-পাথর উত্তোলন কাজে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। একইভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর ও আশপাশের এলাকায় আসা পর্যটকদের মাধ্যমে হাজারো পরিবার উপকৃত হতো। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সব বন্ধ। তাই ঘরে ঘরে অভাব। এবার হাওর এলাকার গ্রামগুলোয় ঈদের আমেজ একেবারেই কম।

জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যমতে, সুনামগঞ্জের ৮৮টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভা বন্যাকবলিত। বন্যায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭১২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৬১টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই হাজার ২৯৫টি পরিবার রয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৯১৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বন্যার্তদের মধ্যে। ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবতা হলো, হাওরে এবার ওইভাবে ঈদের আমেজ নেই। মানুষ নানাভাবে সমস্যায় আছে। প্রশাসন থেকে ঈদের জন্য আলাদা কোনো আনুষ্ঠানিকতা রাখা হয়নি। তার বদলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় থাকা বন্যার্তদের মধ্যে খাবার বিতরণের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনা ও বন্যার সমস্যায় থাকা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি সমাজের বিত্তবান মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।