বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাজধানীর ভেতরে অন্য রকম এক জনপদ

তামান্না আর আশফেকা সমবয়সী। দুজনের বয়সই ৯ বছর। দিনের বেশির ভাগ সময় তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করে কাটায়। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে তামান্না আর আশফেকার মন খারাপ। কারণ পানি।

যে রাস্তায় তারা খেলাধুলা করত, সেখানে এখন হাঁটুর ওপরে পানি। তাদের ঘরে পানি এখনো ঢোকেনি। তবে আশপাশের বহু ঘরে কোমরসমান পানি জমেছে। তাদের এক বান্ধবীর ঘরে পানি ঢুকেছে। এক সপ্তাহ আগে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে তাদের বান্ধবীর পরিবার।

তামান্না বলছিল, ‘এখন ঈদের সময় কিন্তু আমরা পানিবন্দী। বাজারে পানি, রাস্তায় পানি, মানুষের ঘরে পানি। আমরা আগের মতো খেলতে পারি না।’
তামান্নার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আশফেকা বলল, ‘আমাদের এলাকায় বন্যা হয়েছে। আমাদের এখন অনেক কষ্ট।’

বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বালুর পাড় জনপদের ছোট্ট দুই মেয়ে তামান্না আর আশফেকা। ছবি: আসাদুজ্জামান
বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বালুর পাড় জনপদের ছোট্ট দুই মেয়ে তামান্না আর আশফেকা। ছবি: আসাদুজ্জামান

তামান্না আর মুশফেকা বাস করে রাজধানী ঢাকার বালু নদের তীরে বালুর পাড় নামের একটি গ্রামে। এটি ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অংশে পড়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে বালু নদের পানি বেড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটুপানি। পানি ঢুকেছে ঘরের ভেতর। থাকতে না পেরে বহু মানুষ ঘর ছেড়েছে।
বালুর পাড় এমন একটি জনপদ, যেখানে মানুষ বছরের পর বছর নাগরিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ঈদের সময়ে আমার এলাকার অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে। মানুষ অনেক কষ্ট করছে। বন্যায় আমার এলাকার মানুষের এই দুর্দশার কথা আমি মেয়র মহোদয়সহ প্রশাসনের নজরে এনেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পায়নি। তবে আশা করি, প্রশাসন আমার এলাকার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে।’

কাউন্সিলর আকবর হোসেন জানান, তাঁর ওয়ার্ডের উত্তর ইদেরকান্দি, ফকিরখালী, বালুরপাড়, বাবুর জায়গা, নাসিরাবাদ উত্তরপাড়া, নাসিরাবাদ চেকপাড়া, গৌর নগরের অংশবিশেষ, ইসলামবাগ, ত্রিমোহিনী লায়নহাটি, ইমামবাগ, জোড়ভিটা, ত্রিমোহিনী উত্তরপাড়া, নাগদারপাড় এবং শেখের জায়গা নামের এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ঈদের এই সময়ে মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে।

বন্যায় ডুবে গেছে খিলগাঁওয়ের বালুর পাড়ের বাজার। ছবি: আসাদুজ্জামান
বন্যায় ডুবে গেছে খিলগাঁওয়ের বালুর পাড়ের বাজার। ছবি: আসাদুজ্জামান

অন্য রকম এক জনপদ ‘বালুর পাড়’

ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা হয়েও বালুর পাড়ের মানুষ ঈদের এই সময়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। বালুর পাড় নামের স্থানটি খিলগাঁও থানার মধ্যে পড়েছে। এটি থানার শেষ গ্রাম। বালুর পাড়ের একপাশে রূপগঞ্জ, আরেক পাশে ডেমরা। বালুর পাড়ে দেখা গেল, পাকা রাস্তায় হাঁটুর ওপরে পানি জমেছে। কোথাও কোথাও কোমরপানি। এই পানি ভেঙে মানুষ চলাচল করছে।
বালুর পাড়ে যেতে হলে বালু নদ পার হতে হয়। কিন্তু বালু নদের ওপর কোনো সেতু নেই। স্থানীয় মানুষ বছর পাঁচেক আগে বালু নদের ওপর তৈরি করেছেন লম্বা বাঁশের সাঁকো।
বালুর পাড়ের বাসিন্দা রাজিয়া সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু ঢাকা মহানগরের একজন বাসিন্দা। কিন্তু আমরা শহরের ন্যূনতম কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। আমাদের না আছে গ্যাস, না আছে রাস্তা। একটি সেতুর জন্য আমরা কতকাল অপেক্ষা করছি। ভোটের আগে নেতারা কথা দেয়, ভোট দিলে সেতু বানিয়ে দেবে। আমরা ভোট দিই কিন্তু সেতু হয় না। নেতাদের অপেক্ষায় না থেকে আমরা নিজেরা বাঁশের বড় একটা সেতু তৈরি করেছি। এই সেতু দিয়ে এখন আমরা চলাচল করি।’

বন্যায় তলিয়ে গেছে ঘর। ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বাসিন্দা। ছবি: আসাদুজ্জামান
বন্যায় তলিয়ে গেছে ঘর। ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বাসিন্দা। ছবি: আসাদুজ্জামান

দুই সপ্তাহ ধরে বন্যায় চরম দুর্ভোগের কথা বলার সময় আবেগপ্রবণ হয়ে যান রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক অঞ্চলে বসবাস করি, যদি রাতে কারও সমস্যা হয়, তাহলে তাকে আর হাসপাতালে নেওয়ার উপায় নেই। কারণ আমাদের চলাচলের অন্যতম মাধ্যম নৌকা। গভীর রাতে নৌকা পাওয়া যায় না।’

বালুর পাড়ে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় চরম কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের। আবদুস সালামের দোকান আছে ইটখোলা বাজারে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সেই বাজার। সালামের দোকানে হাঁটুপানি। আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার শাশুড়ি হার্টের রোগী ছিলেন। কিছুদিন আগে গভীর রাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নৌকা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার শাশুড়ি মারা গেলেন। আর এখন বন্যায় আমরা যে কত কষ্টে আছি, কত কষ্টে চলাচল করছি, তা কাউকে বোঝানো যাবে না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।’

রাজধানীর বালুর পাড়ে বালু নদের ওপর কংক্রিটের সেতু নেই, কিন্তু আছে বাঁশের বড় এক সেতু। সে সেতু দিয়ে বন্যার এই সময়ে চলাচল করছে মানুষ। ছবি: আসাদুজ্জামান
রাজধানীর বালুর পাড়ে বালু নদের ওপর কংক্রিটের সেতু নেই, কিন্তু আছে বাঁশের বড় এক সেতু। সে সেতু দিয়ে বন্যার এই সময়ে চলাচল করছে মানুষ। ছবি: আসাদুজ্জামান

গতকাল সন্ধ্যায় বাঁশের সাঁকো পার হয়ে হাঁটুপানি ভেঙে বাসায় ফিরছিলেন মো. মিলন হোসেন। তাঁর ছোট্ট ছেলেটি তখন ছিল কাঁধে।
মিলন বললেন, ‘আমাদের রাস্তায় পানি, ঘরে পানি, বাজারে পানি, চারদিকে শুধু পানি। কিন্তু আমাদের দেখতে না এসেছেন কোনো নেতা, না এসেছেন প্রশাসনের লোক। অথচ আমরা এই ঢাকা শহরেরই বাসিন্দা।’

বালুর পাড়ের বাসিন্দাদের সব ক্ষোভ, সব দুঃখ বিনা প্রশ্নে মেনে নিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর আকবর হোসেন। তিনি বললেন, ‘তিন বছর আগে বালুর পাড়সহ নাসিরাবাদ ইউনিয়ন ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তাঁর এলাকার মানুষ বঞ্চিত। আর ঈদের এই সময়ে বন্যার পানি তাঁদের কষ্টকে আরও বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্যার পানিতে ভাসছে আমার এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। বহু মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। বালুর পাড়ের সেতুর জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছি, কিন্তু তা পাস হয়নি। তবে সেতুটি হওয়া খুব জরুরি। একটি সেতুর জন্য বছরের পর বছর মানুষ বড় কষ্ট করছে।’