কুয়াকাটা সৈকতে কোথাও কোনো পর্যটক নেই

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রে এবার ঈদ ঘিরে নেই পর্যটকের আনাগোনা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রে এবার ঈদ ঘিরে নেই পর্যটকের আনাগোনা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রে কোনো কোলাহল নেই। কোথাও কোনো পর্যটক নেই। সুনসান নিরব হয়ে আছে সমুদ্রসৈকতটি। প্রতিবার দুই ঈদ ঘিরে সরগরম থাকে সমুদ্রসৈকতটি। তবে এবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে একেবারে বিপরীত চিত্র। ঈদুল আজহা উপলক্ষে পর্যটক নেই এখানে।

প্রতি বছর ঈদুল আজহার ছুটিকে কেন্দ্র করে ১০–১৫ দিন আগেই কুয়াকাটার আবাসিক হোটেল-মোটেলের কক্ষ বুকিং হয়ে যেত। ঈদের আগের দিন থেকে এখানে ঢল নামত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। অথচ এবার সৈকতের বেলাভূমিতে ঈদের দিন দুই–একজন স্থানীয় মানুষ ছাড়া আর কারও দেখা মেলেনি। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সৈকত খাঁ খাঁ করছে। একই অবস্থা কুয়াকাটার কাছের নয়নাভিরাম গঙ্গামতি সৈকত, জাতীয় উদ্যান, লেম্বুর চর আর শুটকি পল্লির।

পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৮ মার্চ থেকে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাকে লকডাউন ঘোষণা করে। এরপর কুয়াকাটার ১২৭টির মতো আবাসিক হোটেল পর্যটকশূন্য করা হয়। সৈকতের সব ধরনের ভ্রাম্যমান দোকান সরিয়ে নেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় পর্যটনকেন্দ্রিক সব ব্যবসা-বাণিজ্য। গত ১ জুলাই পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র আবার চালু করা হয়। তবে এক মাসেও কুয়াকাটায় প্রাণ ফেরেনি।

পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল নিম্ন আয়ের মানুষগুলো সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। কোনো কাজ না থাকায় এসব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গত চার মাস ধরে সংসার চালাতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। এ রকম একজন মো. আলী হোসেন। বাড়ি কুয়াকাটার পাঞ্জুপাড়া গ্রামে। কয়েক বছর ধরে কুয়াকাটা সৈকতে বাণিজ্যিকভাবে ছবি তোলার কাজ করেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোজা আর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে কুয়াকাটায় প্রচুর লোক সমাগম হইতো। কাছের এলাকার মানুষরাও পরিবারসহ কুয়াকাটাতে বেড়াইতে আসতো। মানুষজন ঘুরে বেড়ানোর ছবি তুলতো। ভালোই আয় হইতো আমাদের। এইবার দুইটা ঈদ গেল। কোনো কাজ পাইলাম না। বইয়া বইয়াই কাটাইলাম।’

মোটরসাইকেল চালক ইব্রাহিম খলিফা বললেন, ‘ঈদের দিন বাদ দেন, গত চার মাস ধরেইতো বেকার হয়ে আছি। আমরা যাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাঁদের বেঁচে থাকাই এখন বড় কষ্টের।’ শামুক-ঝিনুকের দোকানদার শিমুল ফকির বলেন, ‘ঋণে ব্যবসা দাঁড় করাইছি। মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। এখন ধার-দেনা করে সেই কিস্তি দেই। ব্যবসায় পুরাই লোকসান গুনছি আমরা।’

কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর পসরা নিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। বিক্রি না থাকায় এসব দোকানিকে অলস সময় কাটাতে দেখা গেল। কুয়াকাটার অভিজাত হোটেল সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলা, কুয়াকাটা গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতি সবার আকর্ষণ ছিল সব সময়। পর্যটকরা ঈদের সময়টাতে ঘুরতে চলে যেত এ দুটি হোটেল এলাকায়। এ হোটেল দুটির বাগান, লেক, রেস্তোরায় ঠাঁসা থাকতো পর্যটক। এবার ঈদে ভিন্ন চিত্র। নিরব পরিবেশ হোটেল দুটিতে। তা ছাড়া ছোট-বড় প্রায় প্রতিটি হোটেলই এখন ফাঁকা পড়ে আছে। কাজ না থাকায় হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অনেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে গেছেন। তবে আবাসিক হোটেলগুলোতে করোনা পরিস্থিতির জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। কুয়াকাটার অভিজাত হোটেল সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার মহাব্যবস্থাপক ফয়সাল মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর কোরবানির ঈদে আমাদের ১১টি ভিলা এবং টাওয়ার ভবনের ৬৮টি কক্ষের সবকটি বুকিং ছিল। আর এ বছর মাত্র ১০টি কক্ষের বুকিং হয়েছে। আমাদের রেঁস্তোরা, সুইমিং পুল ফাঁকা পড়ে আছে। আমরা পুরাই হতাশ।’

এদিকে কুয়াকাটার আবাসিক হোটেলের প্রধান ফটকে দর্শনার্থীসহ গাড়ি এবং হোটেল কক্ষ জীবানুমুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া কুয়াকাটার সব হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে করোনা পরিস্থিতিতে দর্শনার্থী-পর্যটকদের সেবা দিতে তিন দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহায়তায় এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘এবার দুটি ঈদেই পর্যটকশূন্য ছিল কুয়াকাটা। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করানো যায় না। চিরচেনা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত আমাদের কাছেই অচেনা লাগছে। তবে আমরা নানাভাবে কুয়াকাটাকে সচল করার উদ্যোগ নিয়েছি। যার ফলে ধীরে ধীরে এমন পরিস্থিতির অবসান হবে। পর্যটকদের আনাগোনাও বাড়তে থাকবে।’

কুয়াকাটা পৌরসভার অভ্যন্তরীণ সড়ক, নর্দমা ও আকার্ষণীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্য বর্ধনের ওপর জোর দিয়েছেন পর্যটন নির্ভর ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা বলেন, পৌরসভায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩ কিলোমিটার পাকা নালা নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে ৪ কিলোমিটার নালা নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে কুয়াকাটা রাখাইন মহিলা মার্কেট চত্বর এলাকার নালা নির্মাণে রাখাইন ও স্থানীয়দের জমি ছাড় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টির কারণে সেখানে কাজ বন্ধ রয়েছে। ৩নং ওয়ার্ড এলাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে ওই এলাকায়ও নালা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। কুয়াকাটার আকর্ষণীয় স্থানগুলোতে সৌন্দর্য বাড়ানো হবে বলে জানান পৌর মেয়র।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (কেএইচএমএ) সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশেষ দিনগুলোতে কুয়াকাটা নিরব থাকবে, কোনো পর্যটক থাকবে না, তা কখনোই ভাবিনি। অথচ এবার সে পরিস্থিতিই দেখতে হলো। চার মাসের বেশি সময় ধরেই তো আমাদের সবকিছু বন্ধ আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই নেই। এ সময় শুধু হোটেল ব্যবসায় ১০০ কোটি টাকার ওপর ক্ষতি হয়েছে। শুটকি ব্যবসা, শামুক-ঝিনুকের দোকান, খাবার হোটেল, বিনোদন, বাণিজ্যিক ফটোগ্রাফার, মোটরসাইকেল ও ভ্যানচালক, অটোচালক, সৈকতের ছাতা-বেঞ্চ ব্যবসায়ী, চা-পানের দোকানদার, চটপটি বিক্রেতা, ট্যুর অপারেটরসহ পর্যটনকেন্দ্রিক সব ব্যবসা মিলিয়ে করোনাকালে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।’

এদিকে কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের সেবা দিতে প্রস্তত কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ। তাঁরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে। তাঁদের কাজে গতি ফেরাতে গত ৩ জুন গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে পর্যটন পুলিশের কাজ, কাজের ধরন সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ নিয়ে কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার মধ্যে যত অপরাধ সংঘটিত হবে, সেসবের মামলা ঠিকই থানায় হবে। তবে এসব অপরাধের তদন্ত এখন থেকে আমরাই করব। করোনাকালে সবাই যাতে নিয়মকানুন মেনে চলে সে সম্পর্কে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি। পর্যটন শিল্প বিকাশে কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ সবার পাশে থাকবে।’