নিজের সঙ্গে ১২০ দিন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

গত চার মাসের (মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি) অভিজ্ঞতা আমার কাছে ভীষণ অন্য রকম আর অচেনা। সকালে অ্যালার্মের শব্দ নেই, নেই ঘুম থেকে ওঠার তাড়া বা কাজ জমা দেওয়ার ডেডলাইন।

আমি বরাবরই খুব কাজপাগল। তবে খুব ভালোবেসে যে সব সময় কাজের মধ্যে ডুবে থাকতাম, তা কিন্তু নয়। ব্যস্ততাকে আমিও অন্য অনেকের মতোই সব মন খারাপ আর হতাশাকে এড়িয়ে যাওয়ার এক প্রকার মহৌষধ হিসেবেই ব্যবহার করতাম। তাই এত দীর্ঘ ছুটি আমার জন্য আনন্দদায়ক ছিল না।

তবে আমার অপ্রত্যাশিত গত ১২০ দিনের ছুটি আমাকে অনেকখানি বদলে দিয়েছে, নতুন সমীকরণে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি আমার অসংজ্ঞায়িত মন খারাপ, বিষণ্নতাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারিনি। বরং এই কঠিন সময়টা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে। প্রতিদিন ভয়ানক সব সংবাদ, পৃথিবীজুড়ে মৃত্যুর খবর, কাছের মানুষের জন্য দুশ্চিন্তা, শত শত অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আর ওভারথিংকিং তো চিরকালই আমার সঙ্গী। আমি খুব কম আশাবাদী ছিলাম। বরং ধরেই নিতাম সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হবে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তবে এসবের নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে আমার সবকিছু ঠিকই ছিল। শুধু ঠিক না, বেশ ভালো বলা যায়। আমি দেশের বাইরের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশনের সুযোগ পেয়েছি, স্কলারশিপও পেয়েছি, এর চেয়ে বেশি আনন্দের আমার কাছে কিছু হতে পারে না। বেশ ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগও পেয়েছি ঠিক যে ধরনের কাজ আমি করতে চেয়েছি। আমার পরিবার এবং বন্ধুরা খুব সাপোর্টিভ। তবে সবকিছুর পরও আমি আনন্দটা উদযাপন করতে পারছিলাম না। পরবর্তী সময়ে কী হবে, এই দুশ্চিন্তা আমার পিছু ছাড়ছিল না।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম অন্য কিছুতে ব্যস্ত থেকে আমি আর এই সমস্যাকে এড়িয়ে যাব না। আমি প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলাম আমার সমস্যাটা ঠিক কোথায়। মেন্টাল হেলথ, ডিপ্রেশন, হিউম্যান সাইকোলজি-বিষয়ক বিভিন্ন লেখা, কনটেন্ট পড়তে শুরু করলাম। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি যত বেশি জানতে লাগলাম, তত আমার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা আমার জন্য সহজ হয়ে উঠল। আমি উপলব্ধি করলাম প্রত্যেকের হতাশা বা বিষণ্নতার কারণ ভিন্ন, যা তার দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক, পারিপার্শ্বিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত। আমার যেমন অন্য কারও হতাশার কারণ অযাচিত মনে হতে পারে, তেমনি অন্য কারও কাছে আমারটাও। এই যেমন আমার সমস্যাগুলো শুনে অনেকেই বলেছে ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’। আমরা সচরাচর বলেই ফেলি যে তাঁর জীবন তো পারফেক্ট, তাঁর কেন এ ধরনের সমস্যা থাকবে। কিন্তু হতাশা বা বিষণ্নতার কারণ কী হতে পারে, সে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো এতখানি সহজ নয় বা সফলতা, সচ্ছলতার মাপকাঠি দিয়েও সেগুলোকে চিহ্নিত করা যায় না। আমি বুঝলাম জোর করে বা রাতারাতি এই সমস্যা থেকে বের হতে পারব না। আমাকে সময় দিতে হবে। আমি প্রতিদিন কিছু সময় করে গাইডেড মেডিটেশন করা শুরু করলাম।

কোনো বিষয়ে আমার আগ্রহ না থাকলে আমি তা জোর করে কখনো শিখতে পারি না। এখন অনলাইনে অনেক বিষয়ে অনেক ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ থাকলেও আমি সেগুলো করছি না কেবল সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বা সিভিতে এড করার জন্য। বরং আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি কী করলে আমার ভালো লাগবে, কাজে আসবে কি না, সে হিসেবে যাইনি। লেখালেখি আমার ভালোবাসার একটি জায়গা, লিখে আমি আমার অনুভূতি যতটা প্রকাশ করতে পারি, তা অন্য কোনো ভাবে পারি না। তবে অনেক দিন আমি লেখা থেকে দূরে ছিলাম। একাডেমিক বা কাজের প্রয়োজনে লিখতে হলেও সেগুলো মনের খোরাক মেটাতে পারেনি। আমি পুনরায় লেখা শুরু করলাম। কাজের প্রয়োজনে আমি অনেক কমিউনিটিতে গিয়েছিলাম বিভিন্ন সময়ে। তাদের সংগ্রামের গল্প শুনেছি। ডায়েরিতে লিখেও রেখেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো আমার লেখার মধ্য দিয়ে তাদের গল্পগুলো যদি অন্যরাও জানে, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাদের পাশে দাঁড়াবে।

আমার এক বন্ধু আমাকে অনেকগুলো রঙিন খাম দিয়েছিল। সেগুলোও এত দিন অব্যবহৃত পড়ে ছিল। আমি প্রিয় মানুষ, কাছের বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখছি। অভিব্যক্তি প্রকাশে আমি অপরিপক্ব। তবুও মাঝেমধ্যে প্রিয় মানুষদের জানানো দরকার আমি তাদের ভালোবাসি।

এটি বলব না যে আমি একেবারেই বিষণ্নতা থেকে বের হয়ে হয়েছি। তবে আমি এখন আমাকে চিনি। কোথায় আমার আনন্দ, তা জানি। এই সময়টা কঠিন এবং অস্থির। অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই কিন্তু তবুও আমরা সবাই তো ভীষণভাবে করোনামুক্ত পৃথিবী উদযাপনের আশায় রয়েছি। আর এই আশাই তো রোজ রোজ আমাদের আরেকটু ভরসা দেয়। সেই সুস্থ পৃথিবীতে আমিও আবার কর্মব্যস্ততায় ফিরে যাব, তবে আমার নিজের সঙ্গে কাটানো এই দিনগুলো আমার কাছে খুব বিশেষ হয়ে থাকবে। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমি আমার কথা শুনব!

*ফিল্যান্স রাইটার