হত্যার দায় সিনহা ও সিফাতের ওপর চাপিয়েছে পুলিশ

সিনহা রাশেদ। ফাইল ছবি
সিনহা রাশেদ। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরেন—এমন পোশাক পরা এক ব্যক্তিসহ দুজন মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস সে খবর আগেই পেয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশেই শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশির কাজ শুরু হয়। মৃত্যুর আগে একাধিকবার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান তাঁর পরিচয় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও দিয়েছিলেন।

শামলাপুরে গত ৩১ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। মামলার এজাহারে ফাঁড়ির ইনচার্জের পিস্তল থেকে চারটি গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ আছে। তবে তাঁর মৃত্যুর দায় চাপানো হয়েছে সিনহা রাশেদ ও তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতের ওপর।

টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত ওই ঘটনায় যে মামলা করেছেন, সেখানেই পাওয়া গেছে এসব তথ্য। মামলার একমাত্র আসামি করা হয়েছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। সিফাতের অপরাধ, পরস্পর (সিনহা ও সিফাত) যোগসাজশে সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো।

এর বাইরেও সিনহা মো. রাশেদ খান ও সাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও মামলা করেছে পুলিশ। উদ্ধার দেখানো হয়েছে ৫০ পিস ইয়াবা ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা।

জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে জানানো হয়েছিল—এ কথা এজাহারে আছে? তাহলে পড়ে বলতে হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হলেও তদন্তের পর যে দোষী হবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কমিউনিটি পুলিশের সদস্য নুরুল আমিন (২১) রাত সাড়ে আটটার দিকে ফাঁড়ির ইনচার্জকে মুঠোফোনে জানান, কয়েকজন ডাকাত পাহাড়ে ছোট ছোট টর্চলাইট জ্বালিয়ে এদিক–সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। নুরুল আমিন এ কথা নিজামউদ্দিন ও আরও চারজনকে জানান। স্থানীয় মারিশবুনিয়া নতুন মসজিদের মাইক থেকে পাহাড় থেকে ডাকাত নেমে আসছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ডাকাত প্রতিহত করতে এলাকার সবাইকে একত্র হতে বলা হয়। কিছুক্ষণ পর দুই ব্যক্তি নেমে আসেন। সে সময় ঘটনাস্থলে ২০ থেকে ৩০ জন ছিলেন।

এজাহারে বলা হয়, পাহাড় থেকে নেমে আসা দুজনকে ‌শনাক্ত করার জন্য তাঁদের দিকে মো. মাঈন উদ্দীন নামের (১৯) এক ব্যক্তি তাঁর হাতে থাকা টর্চলাইটের আলো ফেললে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা একজন অস্ত্র উঁচিয়ে তাঁকে (প্রকাশ অযোগ্য) গালি দেন। এলাকার লোকজনকে ধাওয়া করলে তাঁরা অস্ত্রের ভয়ে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নেন। পরে তাঁরা দুজন সিলভার রঙের প্রাইভেটকারে করে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের দিকে রওনা হন। এ খবর নুরুল আমিন নামের এক ব্যক্তি বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জকে জানান। ইনচার্জ জানান টেকনাফ থানার ওসিকে। তাঁর নির্দেশে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে রাত সোয়া নয়টার দিকে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশি শুরু হয়।

নন্দদুলাল রক্ষিত এজাহারে বলেন, মিনিট বিশেক পর তল্লাশিচৌকির সামনে থামার জন্য প্রাইভেটকারকে সংকেত দেন তাঁরা। কিন্তু গাড়িটি সংকেত অমান্য করে তল্লাশিচৌকি অতিক্রম করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ইনচার্জ লিয়াকত আলী তল্লাশিচৌকিতে থাকা ব্লক দিয়ে গাড়িটির গতিরোধ করেন এবং হাত উঁচিয়ে গাড়ির ভেতরে থাকা ব্যক্তিকে বের হতে বলেন। ওই সময় গাড়িচালকের আসনে থাকা ব্যক্তি তর্ক শুরু করেন। তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন। তাঁর পাশে বসা ব্যক্তিটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।

মামলায় বলা হয়, ফাঁড়ির ইনচার্জ এ সময় গাড়িচালকের আসনে বসা ব্যক্তিকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে ধরে দাঁড়াতে বলেন এবং বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন।

নন্দদুলাল রক্ষিত বলেন, ‍‘আইসি (ইনচার্জ) স্যার (লিয়াকত আলী) নিজের ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে চারটি গুলি করেন।’

সেনাবাহিনীর পোশাক সম্পর্কে যা বলেছে পুলিশ

মামলার এজাহারে নন্দদুলাল রক্ষিত বলেছেন, টেকনাফ মডেল থানা এলাকার বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকা। এ এলাকায় আগে থেকেই ডাকাত দলের সক্রিয় অবস্থান ছিল। এ এলাকায় অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকসহ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হয়। বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক পরে বাড়িঘরে লুটপাট করা হয়েছে বলে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে। সিনহা মো. রাশেদের পরনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরেন—এমন পোশাক থাকায় লোকজন তাঁকে ডাকাত ভেবে ধাওয়া দেন।