নাটোরের হালতি বিল যেন 'মিনি কক্সবাজার'

নাটোরের হালতি বিল। ছবিটি গতকাল সোমবার বিকেলে হালতি বিল থেকে তোলা। ছবি: মুক্তার হোসেন
নাটোরের হালতি বিল। ছবিটি গতকাল সোমবার বিকেলে হালতি বিল থেকে তোলা। ছবি: মুক্তার হোসেন

যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে অথই জলরাশি। ঢেউ আর ঢেউ। সেই ঢেউ ভেঙে ছুটে চলে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত অসংখ্য নৌকা। মাঝেমধ্যে দিগন্তরেখায় সবুজের কারুকাজ। সবুজ গাছপালায় ঘেরা একেকটি গ্রাম। প্রতিটি গ্রামের ওপারে আবার দিগন্তজোড়া জলরাশি। এ যেন সাগরের বুকে একগুচ্ছ দ্বীপ। অপরূপ এই দৃশ্য নাটোরের হালতি বিলের। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটা এখন ‘মিনি কক্সবাজার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আকৃতিতে ছোট হলেও এখানে কী নেই! বিশাল জলরাশির মধ্যে রয়েছে ডুবন্ত সড়ক। এটা যেন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোড। শুষ্ক মৌসুমে সড়কটিতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করে। বর্ষায় সড়কের দুই পাড় যখন পানিতে ভরে ওঠে, তখন সড়কটি সমুদ্রসৈকতে রূপ নেয়। সড়কের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতল পানিতে পা ভিজিয়ে পর্যটকেরা হাঁটতে থাকেন। কেউবা পানির বুকচিরে বাইক চালিয়ে সমুদ্রসৈকতের আমেজ উপভোগ করেন। সব শেষে নানা রঙের নৌকায় চেপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে ভেসে চলেন। অনেকে বিলের জলে গা ভিজিয়ে গোসল সেরে নেন। নৌকায় চেপে চলে যাওয়া যায় সোজা পশ্চিমে মাধনগর এলাকায়। এখানে বিল ঘেঁষে চলে গেছে রেললাইন। রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নির্মল বাতাসের স্পর্শ নেওয়া যায়।

হালতি বিল এলাকার প্রবীণ আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বলেন, নাটোর শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হালতি বিলের অবস্থান। প্রায় ৪০ হাজার একর এলাকাজুড়ে বিলটি বিস্তৃত। হালতি বিলকে দেশের সবচেয়ে গভীর বিল বলা হয়ে থাকে। বর্ষায় এর গভীরতা দাঁড়ায় ১২ মিটার। শুষ্ক মৌসুমে পানির বিস্তৃতি কমে এলেও একবারে পানিশূন্য হয়ে পড়ে না। ব্রিটিশ আমলে এই বিলে বিরল প্রজাতির ‘হালতি’ পাখি থাকত। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা পাখি শিকারের জন্য এখানে আসতেন। সেই থেকে বিলটির নাম হয়ে হালতি বিল।

নাটোরের হালতি বিল। ছবিটি গতকাল সোমবার বিকেলে হালতি বিল থেকে তোলা। ছবি: মুক্তার হোসেন
নাটোরের হালতি বিল। ছবিটি গতকাল সোমবার বিকেলে হালতি বিল থেকে তোলা। ছবি: মুক্তার হোসেন

নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে অটোরিকশায় ২৫ থেকে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে হালতি বিলের প্রবেশপথ পাটুলঘাটে পৌঁছানো যায়। এ ছাড়া নলডাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে ১৫ থেকে ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ভ্যান, অটোরিকশায় পাটুলঘাটে যাওয়া যায়। এই ঘাটে বাঁধা থাকে সারি সারি নৌকা। ঘণ্টা হিসাবে চুক্তি করে নৌকায় চেপে হালতি বিলে ঘুরে বেড়ানো যায়। তবে নৌকায় ওঠার আগে জেনে নেওয়া ভালো, নৌকায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসামগ্রী আছে কি না। খাবারের জন্য পাটুলঘাটে আছে কিছু হোটেল।

বর্ষাকালে প্রতিদিনই হালতি বিলে পর্যটকে ঠাসা থাকে। তবে দুই ঈদের সময় ভিড়টা অনেক বেশি হয়। বিশেষ করে বিকেলে হাজার হাজার দর্শনার্থীতে ভরে ওঠে পাটুলঘাট ও মাধনগর রেললাইন এলাকা। বর্ষায় বারনই, আত্রাইসহ বিভিন্ন নদীর পানি বিলে ঢুকে পুরো বিলকে দিগন্তহীন সমুদ্রের মতো বানিয়ে ফেলে। একটু বাতাস বইলেই বিলে ঢেউ ওঠে। শেষ পর্যন্ত ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে খোলাবাড়িয়া, ভূষণগাছা, নুরিয়া, খাজুরা, বিলজোয়ানি, পাটুলসহ সাতটি গ্রামে। বর্ষায় এসব গ্রামের বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। বছরের প্রায় আট মাস বিলে পানি থাকায় এখানে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ থাকে। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার সময় পর্যটকদের অনেকে দেশি মাছ কিনে নেন।

তবে শুকনা মৌসুমে হালতি বিলের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যায়। সারা বিলজুড়ে থাকে সবুজ ধানখেত। কদিন বাদেই তা সোনালি রঙে ভরে ওঠে। বাতাসে দুলতে থাকে মাইলের পর মাইল ধানের শিষ। চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি ধান উৎপাদন হয় এই বিলে। ডুবন্ত সড়কটি জেগে ওঠে, যানবাহনের ছুটাছুটিতে সড়কটি হয়ে ওঠে ওই এলাকার প্রাণ।