কষ্টে বুকটা হাহাকার করে উঠেছিল

শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে স্থাপিত নোয়াখালী কোভিড-১৯ হাসপাতালের ফটক। ২ আগস্ট, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ছবি: প্রথম আলো
শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে স্থাপিত নোয়াখালী কোভিড-১৯ হাসপাতালের ফটক। ২ আগস্ট, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ছবি: প্রথম আলো

হালকা জ্বর-কাশি যখন শুরু হয়, তখনই মনে শঙ্কা ভর করে মিজানুর রহমানের। করোনা পজিটিভ প্রতিবেদন পাওয়ার পর মনটা বিষণ্নতায় ভরে ওঠে। তবে সেসব বিষণ্নতা তুচ্ছ মনে হয়েছে ঈদের দিনের একটা ছবির কাছে। হাসপাতালের ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে স্ত্রী-সন্তান। এতটা দূর থেকেও বোঝা যায় কতটা মলিন তাঁদের মুখ। কষ্টে বুকটা হাহাকার করে উঠেছিল মিজানুরের।

নোয়াখালীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ মিজানুর বললেন, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি সব সময়ই ঈদের দিনগুলো মা ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কাটান। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে আনন্দটা অনেক বেশি থাকে। পশু কোরবানি দেওয়া, রান্না শেষে সবাই মিলে বসে খাওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম। কিন্তু করোনা সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। স্বজনদের দূরে রেখে ঈদের দিনটা কেটেছে হাসপাতালের ভেতরে চরম এক নিঃসঙ্গতায়।

জেলা শহরের পশ্চিম মাইজদী এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪৪)। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা এবং নোয়াখালী নেশা নিরোধ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থায় আছেন বড় পদে। গত ২৩ জুলাই তিনি করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন। পরদিন তিনি নোয়াখালী শহরের শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে স্থাপিত কোভিড-১৯ হাসপাতালে ভর্তি হন।

একই হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রৌশন আক্তার (৫০)। সব সময়ই ঈদের দিনটা স্বামী-সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে আনন্দঘন করে তুলতে কোনো কমতি রাখেন না তিনি। এবারের ঈদের দিনটা কেমন কাটল? মুঠোফোনে প্রশ্ন করতেই আক্ষেপ ঝরে পড়ে কণ্ঠে। রৌশন আক্তার বলেন, বিয়ের অনেক বছর পর প্রথম একটা মেয়ের জন্ম হয় তাঁর গর্ভে। তারপর আরও দুই মেয়ে, দুই ছেলে। বড় মেয়েটা বিয়ে দিয়েছেন একই গ্রামে। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় মেয়ের স্বামী মারা যান। রেখে যান এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে মেয়েটা তাঁর কাছেই থাকেন। সেই থেকে স্বামী, ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে অনেক বড় সংসার তাঁর। ঈদের দিনগুলোতে নিজের হাতে মাংস রান্না করা, সবাইকে এক জায়গায় বসিয়ে খাওয়ানো, কত কাজ তাঁর! কিন্তু এবারের ঈদে কিছুই হলো না। এসব কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।

সব হাসি-আনন্দ দূরে ঠেলে দিয়ে হাসপাতালের চারদেয়ালে বন্দী হয়ে ঈদের দিনটা কেটেছে নোয়াখালী সদর উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের হুগলি গ্রামের বাসিন্দা রৌশন আক্তার। হাসপাতালে তাঁর দেখাশোনা করতে গিয়ে বিধবা মেয়ে পারুল আক্তারও করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন বলে শঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁর নমুনা পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে আসেনি।

ওদিকে স্বামী মারা যাওয়ায় দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বেগমগঞ্জের মাহাতাপুর গ্রামে বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয় রহিমা বেগমের। অভাবের সংসারে সন্তানদের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণের টাকা জোগাড় করতে নানা জায়গায় কাজ করেন তিনি। কয়েক মাস আগে নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে আয়ার কাজ পান তিনি। এরই মধ্যে ওই কলেজে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। রহিমার দায়িত্ব পড়ে হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার ল্যাবে।

এ কথা প্রথমে কাউকে বলতে সাহস পাননি রহিমা বেগম। ১৫ দিন একটানা কাজ করার পর সাত দিনের ছুটি পান। বাড়িতে গেলেও করোনা ল্যাবে কাজ করার কথা পরিবারের কাউকে বলেননি। কাজ শেষে ল্যাবেই ঘুমাতেন। এরই মধ্যে ১৪-১৫ দিন আগে হালকা জ্বর ও কাশি শুরু হয় তাঁর। নমুনা পরীক্ষায় তাঁর শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।

রহিমা বেগম বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পরই তিনি করোনা শনাক্তের কথা বাড়িতে জানিয়েছেন। এ কথা শুনে মা ও ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে। তাদের কাছ থেকে সাহস পাবেন কি, উল্টো তাঁকেই সান্ত্বনা দিতে হয়েছে। এবার ঈদের দিন ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করেছে ছেলেমেয়েরা। সন্তানদের একটু দেখারও সুযোগ হয়নি। কষ্টে যেন বুকটা ফেটে গেছে তাঁর।