আংটি বদল হয়েছিল রেজাউলের

পরিবারের হাল ধরতে ৯ বছর আগে মামা মুরশিদ আলীর হাত ধরে লেবাননে গিয়েছিলেন রেজাউল সিকদার। সেখানে আয়-উপার্জন করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। চার বছর আগে ছোট ভাই মাহবুব সিকদারকেও নিয়ে গেছেন লেবাননে। দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। এরপর নিজের বিয়েও ঠিক হয়েছিল। কনেকে আংটি পরিয়ে রেখেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। করোনা পরিস্থিতিতে দেশে আসতে না পারায় আটকে ছিল রেজাউলের বিয়ে। কথা ছিল দ্রুতই দেশে ফিরে বিয়ে করবেন।

কিন্তু রেজাউলের আর দেশে ফেরা হলো না। লেবাননের বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত বাংলাদেশিদের একজন রেজাউল সিকদার (৩৩)। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মাধবপুর গ্রামে। এই বিস্ফোরণে রেজাউলের মামাতো ভাই রাসেল আলীও (২৩) নিহত হয়েছেন। রাসেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কাইমপুর ইউনিয়নের জাজিসার গ্রামের মুরশিদ আলীর ছেলে। তাঁদের পরিবারে এখন চলছে মাতম।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রাসেল তিন ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় ভাই সাদেক আলীও লেবাননে চাকরি করেন। মেজ ভাই লিয়াকত আলী ঢাকায় সরকারি চাকরি করেন। বাবা মুরশিদ আলীও লেবাননে ২৪ বছর চাকরি করেছেন। তিন বছর আগে তিনি দেশে আসেন। তাঁর আগেই ছোট ছেলে রাসেলকে নিয়ে গেছেন লেবাননে। ভাগনে রেজাউল সিকদার, জামাতা গোলাম রসুল এবং ছোট ভাই জসিম উদ্দিনও তাঁর মাধ্যমেই লেবাননে গিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছিলেন।

রেজাউল সিকদার ও রাসেল আলী। ছবি: সংগৃহীত
রেজাউল সিকদার ও রাসেল আলী। ছবি: সংগৃহীত

কসবার জাজিসার গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ লেবাননে চাকরি করেন। এ জন্য এটি লেবানন গ্রাম হিসেবে এলাকায় পরিচিত হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সকালে নিহত রাসেল আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বাড়িটিতে চলছে কান্নার রোল। রাসেল আলীর মা পারুল আক্তার কোনোভাবেই ছোট ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তিনি ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাড়িতে থাকা মেজ ছেলে লিয়াকত আলীকে জড়িয়ে সারাক্ষণ কাঁদতে থাকেন। সাংবাদিকেরা তাঁর ছবি তুলতে গেলে তিনি বলে ওঠেন, ‘কার ছবি তুলবে? ছবি তুললে তো আমার ছেলে আর ফিরে আসবে না। আমার ছেলেকে শেষবারের মতো দেখার ব্যবস্থা করে দেন।’

নিহত রেজাউলের বাড়ি মাধবপুর গ্রামেও চলছে মাতম। মুরশিদ আলী নিজের ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন। তারপরও বৃহস্পতিবার বোনকে সান্ত্বনা দিতে চলে গেছেন পার্শ্ববর্তী উপজেলায়, মাধবপুর গ্রামে। সেখানে রেজাউলের মা রফিয়া খাতুন পুত্রশোকে আহাজারি করছিলেন।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লেবাননের বৈরুতে গত মঙ্গলবার বিকেলে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর থেকে রাসেল আলী, রেজাউল সিকদার, সাদেক আলী, গোলাম রসুল ও জসিম উদ্দিন কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জসিম উদ্দিন বেড়াতে গিয়েছিলেন অন্য এলাকার এক বন্ধুর কাছে। সেখান থেকে ফিরে হাসপাতালে হাসপাতালে খুঁজেছেন স্বজনদের। গত বুধবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে শনাক্ত করেছেন রেজাউল সিকদারের লাশ। অপর একটি হাসপাতালে পেয়েছেন ভাতিজা রাসেল আলীর লাশ। সেখানে আহত অবস্থায় পেয়েছেন ভাতিজা সাদেক আলী ও ভাতিজি জামাতা গোলাম রসুলকে। তিনি বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছেন লাশ দুটি হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। অন্যরা আহত হলেও বর্তমানে সুস্থ রয়েছেন।

লেবাননের বৈরুতে বিস্ফোরণে নিহত রাসেল আলীর বাড়িতে মাতম। বৃহস্পতিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার জাজিসার গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
লেবাননের বৈরুতে বিস্ফোরণে নিহত রাসেল আলীর বাড়িতে মাতম। বৃহস্পতিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার জাজিসার গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

নিহত রাসেলের মেজ ভাই লিয়াকত আলী বলেন, ‘জসিম চাচা খুঁজতে খুঁজতে হাসপাতালে গিয়ে আমার ছোট ভাই ও ফুফাতো ভাইয়ের লাশ পেয়েছেন। তাদের লাশটি যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়।’ নিহত রেজাউল সিকদারের বোন লিমা আক্তার বলেন, ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আংটি পরানো হয়েছিল। ৯ বছর পর ছুটিতে এসে বিয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে আসতে পারছিলেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই দেশে চলে আসার কথা ছিল। হঠাৎ তাঁদের সব শেষ হয়ে গেছে।

জাজিসার গ্রামের বাসিন্দা ও লেবাননে থাকা এক প্রবাসীর বাবা কবির হোসেন বলেন, লেবাননে জাজিসার গ্রামের চার-পাঁচ শ লোকজন থাকেন। বিস্ফোরণ এলাকায় একই পরিবারের লোকজন থাকতেন। তাঁদের পরিবারের দুজন মারা গেছেন, অন্য দুজন আহত হয়েছেন। তবে গ্রামের অন্য কেউ মারা না গেলেও গ্রামের প্রত্যেক প্রবাসীর পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।

কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ উল আলম বলেন, লেবাননে বিস্ফোরণে নিহত রাসেল আলীর লাশ দেশে আনার জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হচ্ছে। নিহতের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফৌজিয়া ছিদ্দিকা বলেন, নিহতের লাশ দেশে আনার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।