দুর্গত এলাকায় পানি নেই, ঘরে ফিরছে বানভাসি মানুষ
জামালপুরে বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। ঘরে ফিরতে শুরু করেছে বানভাসি মানুষ। গ্রামে গ্রামে ফিরে লন্ডভন্ড রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি দেখে বানভাসি মানুষের আহাজারি শুরু হয়েছে। চারপাশে কেবলই ধ্বংসস্তূপ। ফসলি জমিতেও কাদামাটি। কোথায় থাকবে তারা? তাই এখনো অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে অথবা বিভিন্ন বাঁধে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালাসহ জনপদ এখনো লন্ডভন্ড। বন্যার পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে খেয়ে, না খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটিয়েছে বন্যাদুর্গত মানুষ। সে সময় ত্রাণের সামান্য চাল, এমনকি শুকনা খাবারও ঠিকমতো পায়নি তারা। এখনো সেই খাদ্যসংকট চলছে। বানভাসি মানুষের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা আছে, আছে উদ্বেগ-শঙ্কা।
গত বুধবার সকালে ইসলামপুরের চিনাডুলী ইউনিয়নের আমতলী এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। এলাকায় ঢুকতেই রাস্তাঘাটসহ চারপাশে কেবলই ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে। রাস্তাগুলোতে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তার খোয়া পর্যন্ত পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কিছুদূর পরপর রাস্তা ভাঙা ও গর্ত। পুরো এলাকার ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। ফসলি জমিতে এখনো কিছুটা পানি আছে। প্লাবিত ঘরবাড়িতে এখন শুধু কাদামাটি। রাস্তার পাশে ছোট ছোট ছাপরাঘর। সেখানে রাখা আছে গবাদিপশু। তিন দফায় টানা দুই মাসে পানির তোড়ে তছনছ হয়ে গেছে সবকিছু। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। তাই পানি নেমে গেলেও এখনো সড়ক যোগাযোগ বন্ধ।
ভাঙা সড়ক থেকে হাসিনা বেগম নামের এক নারী ইট সংগ্রহ করছেন। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি সুরের পার গ্রামে। তিনি প্রায় দুই মাস পর বাড়িতে ফিরে দেখেন সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। সব কাদামাটিতে সয়লাব। তাঁর একটি ঘরের পিঁড়া ভেঙে গেছে, তা মেরামত করতে ভাঙা রাস্তা থেকে ইট সংগ্রহ করেন তিনি।
আমতলী বাজারের পশ্চিম পাশে বলিয়াদহ উচ্চবিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের সামনে এখনো হাঁটুপানি। বিদ্যালয়টিতে আশ্রয় নেওয়া ১৫টি পরিবার এখনো আছে। গ্রাম থেকে পানি নেমে গেলেও তাঁরা বসতবাড়িতে ফিরতে পারেননি। তাঁদের অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। অনেকের ঘরে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কারও কারও বাড়িঘর বন্যায় ভেসে গেছে। ফলে তাঁরা ঘরে ফিরে কোথায় থাকবেন, সেই আশঙ্কায় আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাচ্ছেন না।
শিং ভাঙা গ্রামের বাসিন্দা রাশেদা বেগম দুই মাস থেকে এই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়ে আছেন। বানের পানির তোড়ে তাঁর ঘরটি ভেঙে গেছে। তাই তিনি এখনো বাড়িতে ফিরতে পারেননি। বহু কষ্টে সবার সঙ্গে তিনিও আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। রাশেদা বলেন, ‘গ্রামটা নিচু এলাকার। সহজে বান যায় না। এহনো বান ঘরবাড়ি থাইকা যায় নাই। স্কুলে পইড়া আছি। ভাঙা ঘরে যাইয়া কী করুম? দুই মাস ধরে পইড়া আছি। দুইবার ইলিপ (রিলিফ) পাইছি। খাউনের বহু কষ্ট। এক বেলা খাইলে আরেক বেলা উপাস থাকতে অয়।’
এবারের বানে সব হারিয়ে আক্ষেপ করে খালেদা বেগম বলেন, ‘ভাতের দুঃখে মানুষ কলমিশাক আন্দে (রান্না করে) খায়। কয়ঠা ইলিপ দিয়ে হয়। সব মিলে পাঁচজন খাওইনের মানুষ। ৯ কেজি চাল কয় দিন যায়। কোনোরকম টাইনেটুনে তিন দিন যায়। তারপর আর কেউ ইলিপ দেন না।’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার ৭টি উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভা বন্যাকবলিত। ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৬৭৭টি গ্রামের ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭০৭ মানুষ পানিবন্দী ছিল। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১২ হাজার ৮৬৩ হেক্টর জমির ফসল। জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে, নৌকাডুবি ও বন্যাকবলিত হয়ে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।