'মহেশ' শান্ত হয়েছিল আঘাতে, 'শান্ত বাবু' সর্বস্বান্ত করবে একালের গফুরকে?

শখের ষাঁড় ‘শান্ত বাবু’। খামারি আলিমুদ্দিনের সঙ্গে তার বেশ ভাব। সম্প্রতি রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
শখের ষাঁড় ‘শান্ত বাবু’। খামারি আলিমুদ্দিনের সঙ্গে তার বেশ ভাব। সম্প্রতি রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পটির কথা কার না মনে আছে। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ছোটগল্পটি রচনা করেছিলেন জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিক। ছোট্ট শিশু আমিনাকে নিয়ে গফুরের চরম অভাবের সংসার। নিজেদেরই খাবার জোটে না। মহেশ নামের গরুটির খাবার দেবে কীভাবে? ষাঁড়টাকে বিক্রি করতে পারেনি, আবার খাবারও দিতে পারে না। শেষে মাথায় আঘাত করে ক্ষুধার জ্বালা থেকে মহেশকে মুক্তি দিয়েছিল গফুর।

আমাদের চারপাশেও আছেন একালের গফুর। এমনই একজন রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামের আলিমুদ্দিন। তিনি বড় শখ করে পুষেছেন একটি ষাঁড়। নাম দিয়েছেন ‘শান্ত বাবু’। স্বভাবের কারণেই এই নাম। এখন শান্ত বাবুর পেট শান্ত রাখাই দায়। এবারের কোরবানির ঈদের বাজারে ২২ মণ ওজনের গরুটির কোনো ক্রেতা মেলেনি। গফুরকে মহেশের জন্য ভিটে ছাড়তে হয়েছিল। আলিমুদ্দিনকে হয়তো তা করতে হবে না। কিন্তু নিজের শেষ সম্বল দেড় বিঘা আবাদি জমি বন্ধক রাখতে হবে। খেয়ে না–খেয়ে থাকতে হলেও আলিমুদ্দিন আগামী কোরবানির বাজার পর্যন্ত শান্ত বাবুকে পুষতে চান।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা শহর থেকে আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরে কান্দ্রা গ্রাম। গত ৩০ জুলাই পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে একজন পথচারীর কাছে আলিমুদ্দিনের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা জানতে চান এই প্রতিবেদক। ওই পথচারীর পাল্টা প্রশ্ন, একটা ষাঁড় পুষে বিপাকে পড়েছেন, সেই আলিমুদ্দিন কি না? ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব পেয়েই তিনি আলিমুদ্দিনের বাড়িতে পৌঁছানোর উপায় মুখস্থ বলে দিলেন। তাঁর দেওয়া ঠিকানা ধরে আলিমুদ্দিনের বাড়িতে পৌঁছাতে বেগ পেতে হলো না। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বাঁ দিকে শান্ত বাবুর ঘর। সেদিন ছিল খুব গরম। আলিমুদ্দিনের ছেলের বউ সীমা খাতুন পাইপের পানি দিয়ে ষাঁড়টির গা ধুয়ে দিচ্ছিলেন। আর শান্ত বাবু আরাম করে দাঁড়িয়ে ছিল।

আলিমুদ্দিন বললেন, ‘আমার এই পৈতৃক ভিটা ছাড়া দেড় বিঘা আবাদি জমি আছে। শান্ত বাবুকে পোষার জন্য জমিটা বন্ধক দেব। এ আমার ভালোবাসার ধন। আমি না খেয়ে হলেও ওকে আরেকটা বছর পুষব।’

আলিমুদ্দিনের দুই ছেলে। বড় ছেলে আমের মৌসুমে ব্যবসা করেন। সেই উপার্জন দিয়ে ইটের ঘর তুলেছেন। ওপরে টিনের চালা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ। কিন্তু ভেতরের চেহারাটা ভিন্ন। আলিমুদ্দিনকে দিনমজুরি করে সংসার চালাতে হয়। তাঁর ছয় সদস্যের পরিবার। ছয়জনের মুখে খাবার তুলে দিতেই হিমশিম অবস্থা। এখন তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ শান্ত বাবুর পেট শান্ত রাখা।

‘শান্ত বাবু’কে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন আলিমুদ্দিনের ছেলের বউ সীমা খাতুন। সম্প্রতি রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
‘শান্ত বাবু’কে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন আলিমুদ্দিনের ছেলের বউ সীমা খাতুন। সম্প্রতি রাজশাহী পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

আলিমুদ্দিনের ভাষ্য, তিনি গরুকে বাজারে পাওয়া ‘ফিড’ খাওয়ান না। মসুরি, খেসারি ও ছোলা কলে ভাঙিয়ে নিয়ে এসে খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে নিজে খাবার তৈরি করেন। প্রতিদিন শান্ত বাবুর পেটে যায় ১ হাজার ১০০ টাকা। তার খাবার জোগাড় করতে ছেলের সহযোগিতা নিতে হয়। আলিমুদ্দিনের আশা ছিল, কোরবানির ঈদে শান্ত বাবুকে বিক্রি করবেন। কিন্তু করোনা ও বন্যার কারণে এবার বাজার মন্দা ছিল। তাই গরুটিকে বাজারেই তোলেননি। বড় ষাঁড় আছে শুনে কেউ কেউ বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু শুধু দেখছেন যা। দাম আর বলেননি।

আলিমুদ্দিন বললেন, গরু পোষা তাঁর ছোটবেলার শখ। কিন্তু কোনো দিনই তাঁর বাড়িতে গরু এতটা বড় হয়নি। ষাঁড়টাকে খুবই ভালোবাসেন তিনি। একে নিয়ে এখনো বড় স্বপ্ন দেখছেন। কারণ, এসব ষাঁড় মাংসের দামে বিক্রি হয় না। বড় বড় শিল্পপতি শখ করে কিনে নেন। এমন কোনো এক ক্রেতার জন্য তিনি আরেকটা বছর অপেক্ষা করবেন। তাতে যত কষ্টই হোক, সইতে রাজি তিনি।

বোঝা গেল, শান্ত বাবুও খুব ভালোবাসে আলিমুদ্দিনকে। পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় তাঁর সারা গা জিব দিয়ে চেটে দিচ্ছিল ফিজিয়ান জাতের এই ষাঁড়।