গুরুতর আহত সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল পুলিশ!

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তাঁর (সিনহার) অস্ত্রের লাইসেন্স নীলিমা রিসোর্টে তাঁর কক্ষে রয়েছে । পরে সেই কক্ষ থেকে দেশি বিদেশি মদ, এক পুরিয়া গাঁজাসহ শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেপ্তার করা হয়।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথের নামে রামু থানায় দায়ের করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার এজাহারে এ কথা বলেছে পুলিশ।

৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা। একটি মামলায় হয় টেকনাফ থানায়, যেখানে সরকারি কাজে বাধা ও গুলিতে নিহত হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মাদক আইনে অন্য মামলাটি হয় রামু থানায়। দুটি মামলার বাদী পুলিশ।

রামু থানায় করা মামলায় সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলা হলেও টেকনাফ থানার মামলায়, ‘পুলিশ বলছে, চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন । এই নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তাঁর কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, গুরুতর আহত মেজর (অব.) সিনহাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করল কখন এবং তিনি এত প্রশ্নের জবাবই বা দিলেন কীভাবে?

তা ছাড়া টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া মামলা, নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বোন শাহরিয়া শারমিন ফেরদৌসের ফৌজদারি দরখাস্ত কিংবা পুলিশের বক্তব্যের কোথাও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো তথ্য ছিল না ।

রামু থানার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের করা মামলার বাদী উপপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম। তিনি এজাহারে লিখেছেন, ৩১ জুলাই রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে সিনহা মো. রাশেদ খান ও সাহেতুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে আটক করার সময় সিনহা নিজের কাছে থাকা পিস্তল দিয়ে চেকপোস্টে কর্তব্যরত পুলিশকে গুলি করতে উদ্যত হন। সে সময় ফাঁড়ির ইনচার্জ (লিয়াকত আলী) জানমাল রক্ষার্থে গুলি ছোড়েন। এতে সিনহা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। এরপর আহত সিনহা ও তাঁর সঙ্গীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সিনহা জানান, নীলিমা রিসোর্টে তাঁর ভাড়া করা কক্ষে অস্ত্রের লাইসেন্স আছে। রাত সাড়ে ১২ টার দিকে পুলিশ নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালায় ও এক পুরিয়া গাঁজাসহ দেশি বিদেশি মদ উদ্ধার করে ও শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেপ্তার করে।

সরকারি কাজে বাধা ও হত্যার অভিযোগে টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলার বাদী নন্দদুলাল রক্ষিত। কিন্তু সেই মামলার সিনহাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়ে, ‍‍চালকের আসনে থাকা ব্যক্তি নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন। আইসি স্যার (লিয়াকত আলী) তাঁকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে দাঁড়াতে বলেন ও বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। ..কিছুক্ষণ পর মেজর পরিচয় দানকারী ব্যক্তি তর্ক করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন। হঠাৎ কোমরের ডানপাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন।'

এই মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী চার রাউন্ড গুলি ছোড়েন। তিনি সিনহার অস্ত্র নিজের হেফাজতে নেন। সিনহার সঙ্গে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে নাম ঠিকানা নেন। এরপর গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এভাবে দুই মামলায় দুই রকম বক্তব্য নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা এখন কোনো কথা বলতে চান না। জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন বলেন, যারা তদন্ত করছেন এটা তারা দেখবেন।

চরিত্র হননের চেষ্টা

সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর নীলিমা রিসোর্টে যায় রামু থানার পুলিশ। মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি পুলিশ এজাহারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে শিপ্রা দেবনাথের চরিত্র হননের মতো বাক্য একাধিকবার উল্লেখ করেন। এমনকি মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত শিপ্রাকে জেল হাজতে রাখার যে আরজি পুলিশ আদালতে দেয়, সেখানেও ওই অবমাননাকর বাক্যগুলো জুড়ে দেয়।

রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের জানান, তাঁরা শিপ্রাকে রিমান্ডে চান। অন্যদিকে শিপ্রার বাবা নবকুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দিয়েছে পুলিশ।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা এই মামলায় শিপ্রাকে আইনি সহযোগিতা দেবেন। মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেতে তাঁদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।