সিনহাকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ওসি প্রদীপ

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন টেকনাফ থানার সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। টেকনাফের শামলাপুর চৌকিতে তল্লাশির সময় ওসির নির্দেশেই বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী সিনহাকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি ছোড়েন। সব গুলিই সিনহার শরীরে লাগে। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

ওসির সঙ্গে লিয়াকতের ফোনালাপের সূত্র ধরে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘ফোনালাপের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি।’

র‍্যাবের একটি সূত্র জানায়, শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করার ঘটনা ঘটে ৩১ জুলাই রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে। এ সময় পরিদর্শক লিয়াকত ও তাঁর দল ‘ডাকাত ধরা’র প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সিনহা সেখানে পৌঁছালে লিয়াকত পরিচয় জানতে চান। সিনহা গাড়ির ভেতর থেকে নিজের পরিচয় দেন। লিয়াকত তাঁকে হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসতে বলেন। সিনহা বেরিয়ে আসার পরপরই লিয়াকত তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেন।

ওসি প্রদীপের ফোনালাপের সূত্র ধরে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে মোবাইলে ফোন করেন। ফোনে পুলিশ সুপার বিরক্ত হয়ে বলেন, এমন কী হয়েছে বলেন? জবাবে ওসি বলেন, ‘চেকপোস্টে লিয়াকত একটি গাড়িকে সিগন্যাল দিলে গাড়ি থেকে তাঁকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। তখন আমি বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি তাকে গুলি করো। তখন সেও তাকে গুলি করেছে। আমি সেখানে যাচ্ছি।’ পুলিশ সুপার হঠাৎ এ কথা শুনে বলেন, ঠিক আছে যান।

এর এক মিনিট পর রাত ৯টা ৩৪ মিনিটে পরিদর্শক লিয়াকত ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ সুপারকে ফোন করেন। লিয়াকত পুলিশ সুপারকে বলেন, ‘ঢাকা মেট্রো নম্বরে একটি গাড়িতে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা এক ব্যক্তি। তাঁকে চার্জ করলে তিনি মেজর পরিচয় দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে অস্ত্র তাক করলে আমি তাঁকে গুলি করি। একজনকে ডাউন করেছি, আর আরেকজনকে ধরে ফেলেছি।’ জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তোমারে গুলি করছে তোমার গায়ে লাগেনি, তুমি যেটা করছ সেটা তার গায়ে লাগছে।’ লিয়াকত বলেন, ‘জি, স্যার’।

দুই পরিদর্শকের সঙ্গে কথোপকথনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওসি ও লিয়াকতের কাছ থেকে ঘটনা শুনে প্রথমে পুলিশ দপ্তর ও পরে রামু সেনানিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানাই। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলি।’ এই তল্লাশির বিষয়ে তিনি আগে থেকে কিছুই জানতেন না বলে জানান।

>

অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ওসি প্রদীপকে চট্টগ্রামে এক রাত আটক রাখা হয়
সোয়াত সদস্য লিয়াকত গুলি করার আগে ওসিকে ফোন করেন

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পরিদর্শক লিয়াকত পুলিশের বিশেষ টিম সোয়াতের সদস্য। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের জন্য সোয়াত বা স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিস নামের এই বিশেষায়িত দলটি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায় গঠন করা হয়। এঁরা যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সোয়াতের সদস্যরা ‘এআর-১০ স্নাইপার’ ও ‘এম-৪ কারবাইন’সহ দুরবিন লাগানো স্নাইপার রাইফেল দিয়ে এক কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুলভাবে আঘাত করতে পারেন। যে কারণে চোখের পলকে পরপর চারটি গুলি ছোড়েন লিয়াতক। সব গুলিই সিনহার শরীরে লাগে। মামলার এজাহারে চারটি গুলির কথা বলা হয়। তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে সিনহার শরীরে ছয়টি জখমের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন ওঠে, চারটি গুলিতে ছয়টি জখম হলো কী করে। র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এটা পরিষ্কার হবে।

এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ওসি প্রদীপ গত মঙ্গলবার বিকেলের দিকে টেকনাফ ছেড়ে চলে আসেন। বুধবার দুপুরে তিনি বুকের ব্যথা নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হন। এ খবর পেয়ে সেখানে আলাদা একটি কক্ষে তাঁকে আটক করে রাখা হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, প্রদীপ যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য তিনি হাসপাতালে পুলিশি পাহারা বসান। এর আগে প্রদীপের কাছে থাকা অস্ত্র ও গুলি কেড়ে নেওয়া হয়। সারা রাত পাহারায় থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁকে পুলিশি পাহারায় কক্সবাজারে পাঠানো হয়।

প্রদীপ ছাড়াও টেকনাফ থানার আরও ছয় পুলিশ সদস্য বৃহস্পতিবার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। কারাগারে থাকা এই সাত আসামিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। বুধবার সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এই মামলা করেন। অন্য আসামিরা হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। এঁরা এখন কক্সবাজার কারাগারে। গতকাল এই সাতজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

সিনহা হত্যার ঘটনায় দুই বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ঘটনায় তাঁরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। পুলিশের ভাষ্য হলো, এ ঘটনা যিনি ঘটিয়েছেন সব দায় তাঁর। এর সঙ্গে বাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

দুই বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা নতুন নয়, এর আগেও ঘটেছে। বিশেষ করে র‍্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বাগ্‌বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। র‍্যাবের পক্ষ থেকে এ নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে অভিযোগ করা হয়েছিল। তবে অন্য সব ঘটনার চেয়ে এবারের ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক বেশি। এতে বাহিনীর ভেতরে কিছু ক্ষোভেরও সঞ্চার হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত বুধবার সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে বৈঠক করেন। দুই বাহিনীর প্রধান যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর দায় বাহিনীর ওপর পড়বে না। এতে দুই বাহিনীর সম্পর্কেও চিড়ও ধরবে না।

এরপর বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, পুলিশ আশ্বস্ত করেছে, এটাই শেষ ঘটনা।

জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সরকারি দলের সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা, ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সবাইকে সংযতভাবে তার সমাধান করে এগিয়ে যেতে হবে। দিন শেষে এটা মনে রাখতে হবে, দেশের উন্নয়নের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার পক্ষ থেকে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিচার দাবি করা হয়েছে। রাওয়া ক্লাবের সেক্রেটারি জেনারেল লে. কর্নেল (অব.) এ এন মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলন করে আমরা সব দাবি জানিয়েছি। কিছু দাবি পূরণ হচ্ছে। এটা ভালো দিক। তবে জেলা পুলিশ সুপার এখনো ক্ষমতায় আছেন। তাঁকে প্রত্যাহারও আমাদের দাবির মধ্যে ছিল। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমাদের দাবি পূরণ না হলে দরকার হলে আমরা রাস্তায় নামব।’

এ ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা তদন্ত শুরু করেছেন। পর্যায়ক্রমে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।