ফরিদপুরে বন্যায় শতকোটি টাকার ফসল বিনষ্ট

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর। সম্প্রতি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা সলিথা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর। সম্প্রতি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা সলিথা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ৬টি উপজেলার মোট ফসলের প্রায় ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বিনষ্ট হয়েছে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ১০৮ কোটি ৬৫ লাখ। ৬টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৪২৫ জন কৃষক। এর ফলে পরবর্তী চাষাবাদ নিয়ে কৃষকেরা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।

ফরিদপুর সদরের বন্যাদুর্গত নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের কবিরপুর গ্রামের কৃষক মনোয়ার হোসেন (৫৫)। তিনি এ বছর ১২ বিঘা জমিতে আউশ ধান, ১৪ বিঘা জমিতে তিল ও ৮ বিঘা জমিতে বাদাম রোপণ করেছিলেন। তিন দফা বন্যার কারণে তাঁর সব ফসলই পানিতে ডুবে পচে নষ্ট হয়ে যায়।

মনোয়ার হোসেন বলেন, সংসারে স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ মোট ৯ জন সদস্য। এই জমির ফসল দিয়েই তাঁদের সারা বছরের খাবার জোটে। তিনি জানেন না এ ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠবেন এবং ভবিষ্যতে পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গেরস্ত। এ জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্যও পাই না। সব মিলিয়ে বিপদে আছি। এ ছাড়া জমিতে বালু পড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে চাষাবাদ করাও কঠিন হয়ে পড়বে।’

শুধু মনোয়ার হোসেন নন, বন্যায় ফরিদপুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর মতো ৬৩ হাজার ৪২৪ জন কৃষক। ফরিদপুর সদরের আলিয়াবাদ ইউনিয়নের উত্তর সাদীপুর গ্রামের কৃষক তোরাব বিশ্বাস বলেন, তিনি দেড় বিঘা জমিতে আউশ ধান রোপণ করেছিলেন। কিন্তু বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ধানের সব চারা পচে গেছে। একই ইউনিয়নের গদাধরডাঙ্গী গ্রামের কৃষক শেখ বাচ্চুর পাঁচ বিঘা জমির ফসল পানিতে তলিয়ে পচে গেছে।

ফরিদপুর সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোস্তাকুজ্জামান বলেন, বন্যার কারণে তাঁর ইউনিয়নে ৫০০ একর জমির ধান ও ভুট্টা, ৩০০ একর জমির কলাবাগান ও ৫০ একর জমির পাট বিনষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, বন্যায় ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অকল্পনীয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ৬টি উপজেলার মোট ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ ফসল বিনষ্ট হয়েছে। টাকার হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ ১০৮ কোটি ৬৫ লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত এ ৬টি উপজেলায় মোট কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬৩ হাজার ৪২৫ জন। ফরিদপুরের ৯টি উপজেলার মধ্যে বন্যাকবলিত হয়েছে ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর, নগরকান্দা, সালথা ও ভাঙ্গা উপজেলা।

এর মধ্যে ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিলের রোপা আমন ধানের। এ ৬টি উপজেলায় বিলের রোপা আমন বপন করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ৭ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমির ফসল। অর্থাৎ, ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৫১ দশমিক ৯৬ ভাগ।

অন্যান্য ফসলের মধ্যে ৭ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে বোনা আমনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ১৩১ হেক্টর জমির ফসল। ৪ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৬৭ হেক্টরের আউশ, ৭ হাজার ৯৬০ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৩৫ হেক্টর জমির বোনা আমন, ১ হাজার ৫৭১ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৬৪ হেক্টর জমির সবজি, ১ হাজার ২০৫ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ২৬৯ হেক্টর জমির কলা এবং ১২৬ হেক্টর জমির বীজতলা।

মোট হিসাব করলে ওই ৬টি উপজেলার ৩৮ হাজার ২০১ হেক্টর জমির ফসলের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ হাজার ৬৫৮ হেক্টর জমির ফসল। শতকরা হিসাবে ক্ষতির হার ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

এর ফলে আউশ ধানের ২ হাজার ৭৬৬ দশমিক ৫ মেট্রিক টন উৎপাদন কম হবে। রোপা আমনের উৎপাদন হ্রাস পাবে ১ হাজার ১৩১ মেট্রিক টন। বিলে রোপণ করা রোপা আমনের উৎপাদন হ্রাস পাবে ১৫ হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন, সবজি উৎপাদন হ্রাস পাবে ৬ হাজার ৬৯৩ দশমিক ৮ মেট্রিক টন এবং কলার উৎপাদন হ্রাস পাবে ১ হাজার ৯১৫ মেট্রিক টন।

এ ৬টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মোট কৃষকের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৪২৫ জন। এঁদের মধ্যে সদরপুর উপজেলায় ২৭ হাজার ২৪৫ জন, সালথা উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৭৫ জন, সদরে ৮ হাজার ৫২০ জন, ভাঙ্গায় ৮ হাজার ৪২৫ জন, নগরকান্দায় ৩ হাজার ৫০ জন এবং চরভদ্রাসনে ১ হাজার ৭৬০ জন।

ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিচালক আশুতোষ বিশ্বাস বলেন, বন্যায় ফরিদপুরে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের যাতে ভবিষ্যতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যায়, সে জন্য তাঁদের তালিকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকেরা যাতে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ পেতে পারেন, তার উদ্যোগ নেওয়া হবে।