এক মাস আগে এখানে ছিল আশরাফের ঘর

বন্যায় চরটি বিলীনের পথে। এখানে আশরাফ আলীর বসতঘর ছিল। বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া বসতঘরটি দেখাচ্ছেন তিনি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়িচর থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: সোয়েল রানা
বন্যায় চরটি বিলীনের পথে। এখানে আশরাফ আলীর বসতঘর ছিল। বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া বসতঘরটি দেখাচ্ছেন তিনি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়িচর থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: সোয়েল রানা

মাসখানেক আগের কথা। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা নদীর দুর্গম হাটবাড়িচর তখনো বন্যায় ভাসছিল। লোকালয়ের একটি শিমুলগাছের নিচে বসতঘর ছিল প্রান্তিক কৃষক আশরাফ আলীর। শিমুলগাছের কাছেই দোচালা রান্নাঘরে পারিবারিক অনুষ্ঠানের রান্না চলছিল। রান্নার আয়োজন ঘিরে অতিথিদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল কৃষক আশরাফের বসতবাড়ি। 

এক মাস পর আজ মঙ্গলবার আশরাফ আলীর সেই বাড়ির খোঁজে হাটবাড়িচরে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে লোকালয়ের চিহ্ন নেই।

বিধ্বস্ত চরে নেই বসতির চিহ্ন। নেই সেই শিমুলগাছও। যেখানে লোকালয় ছিল, সেখানটা এখন বিস্তীর্ণ বালুচর। পাশেই ছলছল শব্দে বইছে যমুনা নদী। যেখানে শিমুলগাছ ছিল, ভরদুপুরে সেখানে গালে হাত দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল হাটবাড়িচরের সেই কৃষক আশরাফ আলীকে।

আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, এক মাস আগেও এখানে বসতভিটা ছিল, ছিল সাজানো সংসার। এখন সবই নিশ্চিহ্ন, বিরানভূমি। লোকালয়ের অর্ধেকে বইছে যমুনা। আর অর্ধেক ধু ধু বালুচর।

কৃষক আশরাফ আলীর ভাষ্যমতে, যমুনায় পানি ওঠানামা নতুন কিছু নয়। এবারও মধ্য জুন থেকে যমুনার ঢলে প্লাবিত হয় হাটবাড়িচর। মাসখানেক বসতঘর তলিয়ে ছিল বুকসমান পানির নিচে। এরপর হঠাৎ যমুনা খ্যাপা। প্লাবনের সঙ্গে ভাঙন। কয়েক দিনেই লন্ডভন্ড গোটা চর। কোনো রকমে ডিঙিতে সহায়–সম্বল নিয়ে পাশের সোনাতলা উপজেলার তেকানিচুকাইনগরচরে উঠেছেন।

যমুনায় পানি কমতে শুরু করেছে। ডিঙিতে প্রতিদিনই চরে আসেন তিনি। কিন্তু পানি সরে যাওয়ার পর জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ বালুচরে বসতির কোনো চিহ্ন নেই।

চর এখন বিধ্বস্ত জনপদ

শুধু হাটবাড়িচর নয়,বন্যার পানি কমতে শুরু করার পর জেগে ওঠা অধিকাংশ চরই এখন বিধ্বস্ত জনপদ। বসতির বদলে কোথাও বিস্তীর্ণ জলরাশি, কোথাও ধু ধু বালুচর। দুই মাস আগে যেখানে গাছগাছালিতে ঘেরা ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয় ছিল, সেখানে এখন বিরানভূমি। এখনো পান্দিবন্দী চরাঞ্চলের ১ লাখ ৩২ হাজার মানুষ। পানি কমে চর জেগে উঠতে শুরু করলেও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বসতঘরে ফিরতে পারছে না বানভাসি হাজারো মানুষ।

আজ সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়িচর ছাড়াও শিমুলতাইড়, উত্তর শিমুল তাইড়, আউচারপাড়া, সুজনের পাড়া, দলিকারচরসহ বেশ কয়েকটি চর ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

এক মাস আগে হাটবাড়িচরের কৃষক গণি সরকারের বসতবাড়ির সঙ্গে গরুর খামার ছিল। খামারে ছিল ১৪টি গরু। খামারে দাঁড়িয়েই কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। বলেছিলেন, কোরবানির ঈদে খামারের গরু বিক্রি করবেন। এরপর বন্যার পানি নেমে গেলে খেতে আমন ধান লাগাবেন। মাষকলাই, মসুর বুনবেন।

হাটবাড়িচরে যেখানটায় গণি সরকারের বসতবাড়ি ছিল, সেখানে এখন বসতির চিহ্ন নেই। সেই জায়গা এখন ভরা যমুনা।

গণি সরকার নদীর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, ‘উ যে দেকিচ্চেন, উটি হামার বসতঘর আচলো, পাশেই আচলো খামারঘর। এখন বসতঘরের জায়গায় বইছে নদীর স্রোত।’

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই মাস আগেও সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের দুর্গম হাটবাড়ি চরে প্রায় ৪০০ পরিবারের বসতি ছিল। খেতভরা ফসল ছিল, উঠানভরা গাছগাছালি ছিল, ছিল গোয়ালভরা গরু। পানি নামতে শুরু করলেও সেখানে বসতির চিহ্ন নেই। নদীভাঙনে বিলীন হাটবাড়িচরের শত শত বসতঘর, গাছপালা, অবকাঠামো। শ খানেক পরিবার নদীর কিনার থেকে বসতঘর দেড়–দুই কিলোমিটার সরিয়ে নিয়ে বসবাস করছে। আর শ তিনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে আশপাশের বিভিন্ন চরে।

পানি কমতে শুরু করায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরতে শুরু করেছেন কেউ কেউ, নতুন করে বসতি গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

‘উটি হামার বসতঘর আচলো’
হাটবাড়ি চরের জেলে লালচান শেখের বসতভিটা বিলীন যমুনার ভাঙনে। তিনি বলেন, ‘বানের পানির ভয়ে বসতঘর ফেলে বউ-ছল লিয়ে উঠিচি পাশের গুচ্ছগ্রামে। এখন চরত ফেরে দেখি বসতির চিহ্ন নাই। নদীর প্যাটত বসতভিটা।’


এক মাস আগেও দলিকার চরে বসতঘর ছিল দিনমজুর মঈন উদ্দিনের (৬০)। তিনি বলেন, ‘যমুনা এবার বেজায় খ্যাপা। আগে কখনো এমন খ্যাপা দেখিনি। কূল ভাঙল, বসতঘর ভাঙল, আবাদি জমি ভাঙল। ভাঙনের তাণ্ডবে ম্যালা চর বিলীন হয়্যা গেল।’


চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের আউচারপাড়া চরে এক মাস আগেও প্রায় ৪০০ বসতবাড়ি ছিল। বন্যা আর নদীভাঙনে গোটা চর যমুনায় বিলীন। নদীভাঙনে বসতঘর হারিয়ে দিশাহারা মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী সোনাতলা উপজেলার তেকানিচুকাইনগর গুচ্ছগ্রামে।

বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া স্থানে এখন জেগে আছে কলাগাছ। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়িচর থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: সোয়েল রানা
বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া স্থানে এখন জেগে আছে কলাগাছ। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়িচর থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: সোয়েল রানা

আউচারপাড়াচর যেখানে ছিল, সেখানটা এখন ভরা যমুনা। মঙ্গলবার ডিঙিতে বসে জলরাশির দিকে আঙুল উঁচিয়ে স্থানীয় ফরহাদ হোসেন খন্দকার বলেন, ‘উ যে উটি দেকিচ্চেন, লদির মধ্যিত। উটি হামার বসতঘর আচলো। আধা পাকা চারচালা টিনের ঘর, আঙিনাত শজনার বাগান, ঘরভর্তি আসবাব, খেতভরা পাট আচলো। এখন সব লদির প্যাটত। লদিত পানি কমে গেলেও মাথা গোঁজবার ঠাঁই নাই।’


ফরহাদ হোসেন বলেন, দুই মাস আগেও অবস্থাসম্পন্ন কৃষক ছিলেন তিনি। পাঁচ বিঘা জমির পাট ছিল। ২০ বিঘা আবাদি জমি। এখন সব নদীগর্ভে। সব হারিয়ে নিঃস্ব তিনি।


আউচারপাড়াচরের মতোই নিশ্চিহ্ন উত্তর শিমুলতাইড়চর। যেখানে বসতি ছিল, সেখানে এখন ভরা যমুনা। বসতি হারিয়ে ৩০০ পরিবার এখন দিশাহারা।


উত্তর শিমুলতাইড়চরের আকরাম শেখ (৬০) বলেন, ‘হঠাৎ খ্যাপা যমুনা। এক মাসেই সব শ্যাষ হয়্যা গেল। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই।’

উত্তর শিমুলতাইড়চরের আরজ আলী শেখ বলেন, ‘বসতভিটা ছাড়াও সাত বিঘার পাটের খেত যমুনাত বিলীন। এখন খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্চি।’

উত্তর শিমুলতাইড়চরের নজরুল শেখ বলেন, ‘বসতবাড়ি, জায়গাজমি সব যমুনাত শ্যাষ। বানের পানি কমলেও কোনটি যাওয়ার জায়গা নাই।’


চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই ইউনিয়নে ১৩টি চরের মধ্যে দুই মাসের নদীভাঙনে ছয়টি চর নিশ্চিহ্ন। এতে চার হাজার মানুষ এখন আশ্রয়হীন। যমুনায় পানি কমলেও বসতভিটায় ফেরার উপায় নেই।


সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া বলেন, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে ১ লাখ ৩২ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী।