ঋণ দেওয়ার চটকদার বিজ্ঞাপনে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা

চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাংক ঋণ জুটিয়ে দেওয়া কথা বলে প্রতারণার অভিযোগে আটক তিনজন। ছবিটি আজ বৃহস্পতিবার বগুড়া গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাংক ঋণ জুটিয়ে দেওয়া কথা বলে প্রতারণার অভিযোগে আটক তিনজন। ছবিটি আজ বৃহস্পতিবার বগুড়া গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

‘আপনি কি স্বল্প শিক্ষিত বেকার, নতুন উদ্যোক্তা? নিজে কিছু করতে চান? হতে চান সফল ব্যবসায়ী? আপনার কি লোন প্রয়োজন? নতুন উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থানের জন্য এক হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মিল-কারখানা ও ফ্যাক্টারি স্থাপন, কৃষি ঋণ, ব্যবসা ঋণ, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে ঋণ, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোক্তাসহ সব ধরনের হোম লোন দেওয়া হয়। বিদেশি ফান্ড লোন পেতে চান? দেশি-বিদেশি ৩২ ব্যাংক থেকে শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে ঋণ প্রসেসিং করা হয়। ঋণ পেতে যোগাযোগ করুন।—ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক লোন সার্ভিস লিমিটেড।’

পুলিশের দাবি, ভুয়া ২২টি অনলাইন পোর্টাল ও ৩৫টি ফেসবুক পেজ খুলে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে স্বল্পপুঁজির উদ্যোক্তা ও বেকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এই প্রতিষ্ঠানের লোকজন। শর্ত ছাড়াই বিপুল অংকের ঋণ মঞ্জুরের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন। ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আগেই নির্দিষ্ট কমিশন বাবদ হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় রীতিমতো অফিস খুলে বসেছিল চক্রটি। জামানত ছাড়াই কোটি টাকার ঋণ পাওয়ার লোভে সেই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বহু মানুষ।

এই চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হওয়া বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার আমানুল্লাহ তারেক (৩৩) নামের এক উদ্যোক্তা মামলা করেন। এই মামলায় পুলিশের জেলা গোয়েন্দা শাখার সাইবার ইউনিটের একটি দল গতকাল বুধবার বিকেলে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় অভিযান চালিয়ে যুবলীগ নেতা রাব্বি শাকিল ওরফে ডিজে শাকিল (৩০) ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া শাকিল সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস গ্রামের বাসিন্দা। গ্রেপ্তারের পর তিনি নিজেকে রিশান গ্রুপের চেয়ারম্যান বলে দাবি করেন। তাঁর দাবি, তিনি তাড়াশ উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য। তাঁর বাবা কাজী গোলাম মোস্তফা তাড়াশ উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি। শাকিল নিজেকে রিশান নিউজ এজেন্সির অর্ন্তভুক্ত ৫৭টি অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক ও প্রকাশক দাবি করে তাঁর কার্যালয়ের সামনে সাইনবোর্ড টানিয়েছেন।

শাকিলের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া একজন হলেন হুমায়ুন কবির লিমন (২৮)। পুলিশের কাছে তিনি নিজেকে রিশান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং শাকিলের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় বের হওয়া ৫৭টি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক দাবি করেছেন। তাঁর বাড়ি তাড়াশ উপজেলার কুশুম্বি গ্রামে। আরেকজন হলেন রিশান গ্রুপের ব্যবস্থাপক ও আইটি বিশেষজ্ঞ হারুন রশিদ ওরফে সাইফুল ইসলাম (২৬)। তাঁর বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার গাড়িখেত গ্রামে।

পুলিশ সূত্র জানায়, এই তিনজনের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া বিভিন্ন জেলার ২৬ জনের নামে মঞ্জুর করা এক হাজার ২০১ কোটি টাকার পূবালী ব্যাংকের ভুয়া চেকের পাতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নিয়োগপত্র ও চুক্তিপত্র, ২২টি অনলাইন পোর্টালের লিংক ও ৩৫টি ফেসবুক পেজের লিংক, সাতটি ব্যাংক একাউন্টের নথি, সাংবাদিক পরিচয়পত্র, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের জাল নথি, ভুয়া চেক বই, সিল, নকল নিয়োগপত্র তৈরির বিপুল সরঞ্জাম।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন যে তাদের নিউজ পোর্টালে সাংবাদিক নিয়োগের নামে অর্থ হাতিয়ে নিতেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সাইবার ইউনিটের দায়িত্বে থাকা বগুড়া ডিবি পুলিশের পরিদর্শক এমরান মাহমুদ তুহিন বলেন, প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে বগুড়া সদর থানায় দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রতারণার পৃথক দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তিনজনকে আজ বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, রাব্বি শাকিল তাঁর এলাকায় ডিজে শাকিল নামে পরিচিত। তিনি এক সময় রিশান গ্রুপ অব কোম্পানিজ খুলে জুস, চানাচুরের মতো ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শুরু করেন। অনুমোদন ছাড়াই তাড়াশের কাওরাইল এলাকায় ভোগ্যপণ্য উৎপাদন কারখানায় বছরখানেক আগে প্রশাসন অভিযানও চালান। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ব্যবসার আড়ালে শাকিল অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। তিনি তাঁর কার্যালয়ের সামনে রিশান নিউজ এজেন্সি নামে ৫৭টি অনলাইনের তালিকা সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড টানান। নিজেকে এসব পোর্টালের সম্পাদক ও প্রকাশক পরিচয় দিয়ে আসছেন। এসব পোর্টাল খুলে সাংবাদিক পরিচয়পত্র বিক্রির বাণিজ্য ছাড়াও ফেসবুক পেইজ খুলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন। গত বছর তাঁরা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক লোন সার্ভিস নামে একটি অনলাইন পেজে দেশে-বিদেশের ৩২টি ব্যাংক থেকে বন্ধক ছাড়াই মোটা অংকের লোন পাইয়ে দেওয়ার ভুয়া বিজ্ঞাপন দেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, চটকদার ওই বিজ্ঞাপন দেখে বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার আমায়রা এগ্রো ফার্ম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আমানত উল্লাহ তারেক এবং শহরের দক্ষিণ কাটনাপাড়ার আশিক দৌলতানা নামে দুজন শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শাকিল কয়েকজন সঙ্গীসহ গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর বগুড়া শহরের দুই উদ্যোক্তার প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন। কিছু কাগজপত্র নেওয়ার পর আমানত উল্লাহর নামে আড়াই কোটি এবং আশিকের নামে দুই কোটি টাকা ঋণ দিতে রাজি হন। তবে এ জন্য দুজনকে আগাম ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে বলে জানান শাকিল। প্রতারণার ফাঁদ বুঝতে না পেরে দুই উদ্যোক্তা শাকিলের হাতে প্রথমে দুই লাখ টাকা তুলে দেন। এরপর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ভুয়া ঋণ মঞ্জুরপত্র প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বস্ততা তৈরি করে ধাপে ধাপে তাদের দুজনের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর গত বছরের ১১ নভেম্বর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিল দেওয়া আমানত উল্লাহর আমায়রা এগ্রো ফার্মের নামে আড়াই কোটি এবং আশিক দৌলতানার অভি এগ্রো ফার্মের নামে দুই কোটি টাকার ব্যাংক চেকের স্ক্যান কপি দেন। মূল চেক দিতে টালবাহানা শুরু করলে আমানত ও আশিকের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা চেকের স্ক্যান কপি ও ঋণ মঞ্জুরপত্র যাচাই করতে বগুড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কার্যালয়ে খোঁজ নেন। জানতে পারেন এগুলো ভুয়া। ১২ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল লোন সার্ভিসের নামে আমনত উল্লাহ বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শাকিলের বাবা ও তাড়াশ উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফাকে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।